সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-৪) | Sobujdweeper Diary Ep#4

 "সবুজদ্বীপের ডায়েরি" 
(আন্দামান পর্ব-৪)

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 26th February 2020 । রাত ১১টা ........
আজ সারাটাদিন বলতে গেলে একরকম ঘোরে কেটেছে। সেই সাতসকালে তো বেরিয়ে পড়েছি। গন্তব্য ছিল "Jolly Buoy" দ্বীপ। আমরা অনেকেই জানি এই দ্বীপের চারিপাশ ঘিরে রয়েছে প্রবালের অফুরন্ত ভান্ডার। অস্ট্রেলিয়ার পরেই দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ Coral Reef-এর সম্পদ রয়েছে এখানে। যাবার জন্যে সমুদ্রপথে লঞ্চ ছাড়া গতি নেই। এই লঞ্চ ছাড়ে অন্য আরেকটি জেটি Wandoor থেকে। সময় লাগে ঘন্টাখানেক মতো। পোর্টব্লেয়ার থেকে বাসে Wandoor যেতে দূরত্ব ত্রিশ কিলোমিটার, সময় লাগল আধঘন্টা। এই Wandoor ও Jolly Buoy দ্বীপ মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের Marine Sanctuary'র তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। খুব সুন্দর নামের আরেকটি দ্বীপ 'Red Skin Island'ও এই একই Wandoor জেটি থেকে যেতে হয়। তবে সাধারণতঃ পর্যটকরা এর যেকোন একটি দ্বীপ বেড়াতে যান। কারণ, এই বিপুল পরিমাণ কোরালের ভান্ডারকে রক্ষা করতে একই সময়ে যে কোন একটি দ্বীপেই যাওয়ার ছাড়পত্র পাওয়া যায় আন্দামান প্রশাসন থেকে। একটি দ্বীপ খোলা থাকলে অন্যটি বন্ধ রাখা হয় বাইরের অভ্যাগতদের জন্যে। Wandoor-এ যথারীতি সকলের ID Proof পরীক্ষা করে লঞ্চে ওঠবার ছাড়পত্র পেলাম। শুধু তাই নয়, Coral-কে বাঁচানোর জন্য এই দ্বীপে কোন খাবারের স্টল নেই। প্লাস্টিক জাতীয় কোনকিছুই সঙ্গে নেওয়া চলবে না, এমনকি জলের বোতল পর্যন্ত। বয়স্করা সঙ্গে বিস্কুটের প্যাকেট আর জল এনেছিলেন - সেগুলো সব জমা পড়ল Security Desk-এ। বিয়াল্লিশ জনের নাকচ হওয়া কেক-বিস্কুটে Coastal Guard-দের আজকে অন্ততঃ টিফিন খরচ বেঁচে যাবার কথা।


অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পর্যটকদের অজ্ঞানতাবশতঃ সঙ্গে নিয়ে আসা ছোটখাটো জিনিস বা খাদ্যবস্তুর প্রতি কাস্টমস অফিসার বা সিকিউরিটি গার্ডদের একটা বিশেষ আকর্ষণ থাকে। একই পথে প্রত্যাবর্তন থাকলেও বাজেয়াপ্ত মাল ফেরত দেবার বেলায় এনাদের অনাগ্রহ বিস্মিত করে।

আমাদের দুই পরিবারের এই চারজনের দলের বয়স - ঠিক না নবীন না প্রবীণ - কেমন একটা মাঝামাঝি জায়গায় ঝুলে আছে। তাই উৎসাহের তীব্রতা ত্রিভুজের মাথায় পৌঁছে স্থির হয়েছে।উৎসাহের মাত্রা শীর্ষে বিচরণ করলেও সামর্থ এরপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিম্নমুখী হবে, সেটাই নিয়ম । তাই বিচক্ষণতা সময়মত সাহায্য করল। আমরা কঠিন ও তরল - দুই ধরণের খাবারই হোটেলে সেরে শুধু মাথার টুপি আর কাঁধের ছোট ব্যাগ নিয়ে চলেছি। সুতরাং আমাদের দিক থেকে কোস্টাল গার্ডেরা কিছুটা আশাহতই হয়েছেন, এমনটা মনে করায় খুব দোষের হবে না - সবই নিয়তি। 

তৃপ্তিবৌদি ও অরুণদা
আমাদের মধ্যে একজন, পরে আলাপে জেনেছিলাম পেশায় ডাক্তার - বেশ চোখে পড়বার মতো তাঁর শারীরিক গঠন আর হাঁটা-চলা, কথা বলার মধ্যে ঝকঝকে স্মার্টনেস - তিনি শুধু চোখে ক্যামেরা লাগিয়ে এই পাগল-করা প্রকৃতিকে ক্যামেরার ফ্রেমে আপন করবার নেশায় আমাদের থেকে কখনো কাছে, কখনো দূরে, বেশ একা একাই লুকোচুরি খেলছেন। ফলে, আমাদের পুরো দলের বাকিরা আনমনে অজান্তেই এই লুকোচুরি খেলায় অংশ নিচ্ছেন। এই চোখের ডাক্তারবাবুকে হঠাৎ কখনো চোখে পড়ছে, কখনো বা কোথায় যেন অদৃশ্য। ফলে এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সম্বলিত বুদ্ধিদীপ্ত মুখের সৌম্যদর্শন ভদ্রলোকটি বাকিদের মনে ঠাঁই পেয়েছেন বিনা পরিশ্রমে, সে কথা বলাই বাহুল্য। এনার আরো কথা পরে বলব। 

দ্বীপ থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমাদের জাহাজ বা বড়ো লঞ্চ থামল। ভাসমান জেটি থেকে - এবার চোদ্দ জন করে মোটর বোটে পাড়ি দেব দ্বীপের উদ্দেশে। একটি মোটর বোটে সর্বাধিক চোদ্দজনই বসতে পারে। কারণটা স্পষ্ট হলো বোটে ওঠবার পর। বোঝা গেল, এই মোটরবোটটি বিশেষভাবে নির্মিত। এর বেস বা তলার অংশ সাদা স্বচ্ছ Magnifying Glass Fibre দিয়ে তৈরী - যাতে সমুদ্রের ১০০ ফুট পর্যন্ত গভীরের জীবন বোটে বসেই চাক্ষুষ করা যায়। এক ঘন্টার সফরের খরচ মাথাপিছু ১০০০ টাকা। সকলেই প্রায় রাজি হলাম এই সফরে। আসলে মহাকাশ ও মহাসমুদ্র নিয়ে মানুষের কৌতূহলের কোন শেষ নেই। এদের সম্পর্কে কোন জানাটুকুই যথেষ্ট নয়। তাই আমাদের বোটযাত্রীদের মাথা নুইয়ে পড়ল বোটের স্বচ্ছ মেঝেতে, যতটা না ভক্তিতে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্ময়ে। সকলেরই চোখে শুধু জলের রঙ্গীন মানচিত্র। 

নানা রং, নানা গঠনের Coral, আর তার শরীরের অসংখ্য ছিদ্রপথে রঙ্গীন মাছের আনাগোনা - অপার বিস্ময়ের ঘোর লাগল আমাদের মনে। মাঝিই এখানে গাইড, সে বলল -'এবার আপনাদের দেখাব Sea Lily, Lobster, নানাবর্ণের Starfish, মস্ত মাপের ঝিনুক, Octopas'। মনে হচ্ছিল মাঝির সাথেই বোটে থেকে যাই। 'Jolly Buoy' দ্বীপের স্কুবা ডাইভিং, স্নোর্কেলিং বিখ্যাত এই প্রবাল-প্রাচীরের জন্যেই।   

এক ঘন্টার মন-মজে যাওয়া অভিজ্ঞতা নিয়ে পা রাখলাম দ্বীপে। তবে আজ নয়, সেই দ্বীপ-কাহিনী পরের পর্বে। 
চলবে......
'সবুজদ্বীপের ডায়েরি' প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 
আন্দামান পর্ব-৫ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
©tapanbasu
all image clicks : tapanbasu(author)

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু