স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু

স্টেরয়েড
ছোট গল্প 
রচনা : তপন বসু 

স্টেরয়েড, স্টেরয়েড  ........  লাগবে না কি বাবু ? - হাঁক পাড়ে ফেরিওয়ালা। 

উৎসুক পল্লীবাসীর উঁকিঝুঁকি। প্রশ্ন ভেসে আসে - 'কি বিক্রি করছ ? স্টেরয়েড ? মানে ইঞ্জেকশন ? ওষুধ'?

হ্যাঁ গো বাবুমশায়েরা। ইঁদুর মারার, আরশোলা মারার ওষুধ যখন বিক্রি করতুম তখন তো তোমরা, ছেলে-ছোকরারা আমায় বলতে, 'মানুষ মারার ওষুধ আছে '? 

'এই তো এনেছি, এবার নাও দেখি - এতে মানুষ যেমন মরবে, আবার বাঁচবেও - হ্যাঁ গো সত্যি বলছি গো' - ফেরিওয়ালার শেষের কথায় ঘাম ঝরা বেদনা ফুটে বেরিয়ে আসে। 

ঝুম্পা বৌদি আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট-বাড়ির উপরতলার বাসিন্দা।  পাঁচ তলার বারান্দা থেকে এতক্ষণ টপ ভিউ নিচ্ছিল। বেশ মজা পেয়ে রসিকতার আমেজে বললে, 'তো এটা কিভাবে নিতে হবে? কতক্ষণ লাগবে শুনি মরতে' ? 

ফেরিওয়ালা খুব সিরিয়াস - 'দেখছেন না আমার এই বাক্স? এতে বরফ দিয়ে মোড়া আছে - যেমন ইনসুলিন নাও গো তোমরা, শুধু হাতে ফুটিয়ে দিলেই চলবে। যদি অন্যকে মারতে চাও, ঠিক বলতে পারব না ; আর যদি নিজে মরতে চাও, তাহলে বেশিক্ষণ লাগবে না'।

ঝুম্পা বৌদির ঠিক উল্টোদিকে মধ্যবয়স্কা তপশ্রীদি, স্কুল টিচার - 'ছুটির দিনের ঘুম ভাঙা সকালে ঘটনার মজা ও বাস্তবের ফেরিওয়ালা তার শিক্ষার বোধিবৃক্ষে প্রশ্নের উস্কানি দিল - 'অন্যের মরতে বেশি সময়, নিজের বেলায় কম কেন'?

ফেরিওয়ালা জন্মের না মৃত্যুর - ঠিক কার দূত হয়ে এসেছে কে জানে? গলা চড়িয়ে বললে, 'যাকে একবার দেবেন, সে যদি জানতে না পারে যে কি দেওয়া হলো - তা হলে  ...... মরতেও পারেন, আবার নাও মরতে পারেন, চান্স কম। আর যদি কোনভাবে তিনি জেনে যান - তা হলে এই একটু ধস্তাধস্তি, মারামারি ----- বেশিক্ষণ লাগবে না, সাবধান কিন্তু। আর নিজে নিলে তো কথাই নেই, ফোটাবেন আর ফুস' -----

'এই, ফুস মানে' ? এবার মুখোমুখি সওয়াল কবি'দার। কবি'দা শখের কবিতা লেখেন আর পাঞ্জাবির পকেটে লেটেস্ট লেখা নিয়ে রাস্তায় বেরোন। সুযোগ পেলেই শোনাতে চান নিজের সৃষ্টি, শ্রোতার ইচ্ছে না থাকলেও। ভাল নাম বারীন্দ্র - তার কবিতাপ্রেমে পাড়ার লোক মজা করে কবি'দা বলে ডাকত। এখন আসল নামটা লোকে ভুলেই গেছে। বয়স বিরাশি, এখনো বেশ ফিট, সেটা বোঝেন বলেই মাতব্বরি বেশি, প্রশ্নও আরো বেশি। 

ফুস বললেই হলো ? নেব আর মরে যাব ? আমার কি কেউ নেই ভাবছিস নাকি ? ইয়ার্কি পেয়েছিস ? এসব পারমিশন ছাড়া ভ্যান-এ করে বিক্রি করা যায় ? তোকে আমি পুলিশে দেব'।  - কবি'দা অসম্ভব উত্তেজিত। 

ফেরিওয়ালা সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবার। ভেঙে পড়া শরীরের দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করে। 'বাবু! আপনি যদি জেনে যান যে এই ওষুধে আপনি মরতে পারেন, তাহলে ফুস করে। .... একবারে ওপরে। ভয়, ভয় বাবু ভয়।  .....আর এটা ২০৪১ সাল। সরকার সমস্ত কিছুর ঢালাও পারমিশন দিয়েছে, চাইলে আপনিও বিক্রি করতে পারেন। মানুষ মারবার দায়িত্ব কি শুধু হাসপাতাল আর ডাক্তারের নাকি?' ফেরিওয়ালার গলা মনে হলো চাপা কান্নায় বুঁজে এল।   

আমার ফ্ল্যাটের পাশেই নিজের একতলা বাড়িতে থাকেন ডাক্তার মুখার্জি - 'তুই যদি এগুলো বেচবি তো আমরা কি করব' ? 

আমি এতক্ষণ খাটে শুয়েই ঘুমের আড় ভাঙছিলাম, ডাক্তারের প্রশ্নে কেমন যেন গ্লানির সুর না ? 

ফেরিওয়ালার উত্তর শোনা যায়। 'আপনারাই তো বেচছেন বাবু, আপনাদের বিবেক আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অসহায়তা। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে একুশ সালে বেচেছি আমি নিজেকে, আমার চাকরির সব উপার্জন, নিজের সততা - বত্রিশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। সব তুলে দিয়েছিলাম আপনাদের হাতে। তাতেও বাঁচাতে পারিনি আমার বৌকে, আমার একমাত্র মেয়ে পুতুল'কে। ওদের আমি শেষ দেখাও দেখতে পারি নি। কার নির্দেশে, কোন আগুনে তারা  পুড়ে মরল আমি আজও জানি না বাবু'....... হাহাকারের কান্না রাস্তার দু'ধারের বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে ছুটির জীবনের চলার শব্দকে চুপ করিয়ে দিল। 

ছুট্টে এলাম বারান্দায় লোকটাকে দেখতে - হাহাকারের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ভাসছে এই রাস্তার সাজানো বাড়িগুলোর বারান্দায়, দরজায়, জানলায়। পর্দাগুলো স্থবির নিথর দেহ হয়ে ঝুলছে। ডুকরে ওঠা কান্নার অনুরণন রয়েছে, লোকটা নেই। 

ডাক্তার চেম্বারে বেরোচ্ছেন, তাঁকে শুধোলাম - 'আচ্ছা ওই ফেরিওয়ালাটা কোথায় গেল, যে স্টেরয়েড বেচছিল' ?   

'কি উল্টোপাল্টা বকছেন অমিয়দা' ! স্টেরয়েড খোলা বাজারে পাওয়া যায় নাকি' ? সক্কাল সক্কাল এমন প্রশ্নে বিরক্তি চাপা থাকে না ডাক্তারের। 

একটু সামলে নিয়ে তিনি বলেন, 'আচ্ছা অমিয়দা, আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন, না মনের ভুল ! স্টেরয়েড তো একমাত্র আমরা বিক্রি করি, বুঝে রোগীকে দিই ডোজ কম-বেশি করে'।  
 
অমিয়দা সেন্ট্রাল ভিজিলেন্সের উঁচু পোস্টে চাকরি করে সবে অবসর নিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে দুর্নীতির কথা শোনা যায় না। তিনি কেমন আমতা আমতা করেন, 'কিন্তু আমি যে শুনলাম, বত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ করেও লোকটা বাঁচাতে পারে নি তার মেয়ে-বৌ কে' ?
 
রাখুন তো মশাই ! বত্রিশ লক্ষ - অনেক রোগী ওরকম আসে আমাদের কাছে, বুঝলেন ? বোঝাচ্ছি যে এ রোগীর ঠিক হওয়ার আশা কম, তবু 'ডাক্তারবাবু একটু দেখুন না, আপনি পারবেন, আমার যে আর কেউ নেই' - এই সব বলে ভর্তি করে হাসপাতাল, নার্সিং হোম-এ। তো আমরা কি করব ? কেউ যদি জেনে শুনে টাকা খরচ করে ? আর আমাদের বলছেন, মন্দিরে কি হচ্ছে অমিয়দা, সেখানে তো ভগবানকে দেখা যায় না, কথাও বলা যায় না। লক্ষ-কোটি টাকা বিলিয়ে দিচ্ছে মানুষ। কই, সেখানে তো বিশ্বাসের দরজায় ঝড় উঠছে না ? যত দোষ সব আমাদের। কোথা থেকে কি শুনলেন, অমনি আমাকেই পেলেন ফালতু প্রশ্ন করবার। আপনাকে সম্মান করি অমিয়দা, রাত্রে কি ঘুমের সমস্যা হয় আপনার' ?

ডাক্তারের উষ্মা'র কারণ বুঝলেন না অমিয়দা, কথাগুলোও ঠিক কানে ঢুকলো না অমিয় সান্যালের, তাঁর মনে হলো, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কোবিদ নামের এক ভাইরাস ঝড়ে লক্ষ লক্ষ প্রাণ হারিয়ে গিয়েছে অকালে, সারা বিশ্বজুড়ে। ফেরিওয়ালা কি তাদের অগ্রদূত ? ডাক্তার-হাসপাতাল-রাজনীতি আর মিডিয়ার খেলা, সমস্তই তো আজ চোখের সামনে পরিষ্কার। বিস্তর লেখালেখির ঢেউয়ের পর পৃথিবী আজ অন্য খেলায় মত্ত। মানুষের হাতেই মানুষের প্রাণ - তাহলে ফেরিওয়ালা কি সত্যি বলে গেল ? মৃত্যুর পরোয়ানা কি আজ যে কেউ লিখতে পারে ?

ডাক্তারের শেষ কথাগুলো কানে ভাসছে ফেরিওয়ালার কান্নার সাথে সাথে 'ডাক্তার দেখান অমিয়দা, দেরি করবেন না। পারলে আমার চেম্বারে আসুন, আমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলিয়ে দেব। বাড়াবাড়ি হলে দু-একটা স্টেরয়েডের ডোজ নিলেই কমে যাবে'।

কবি'দা কই, কবি'দা ? উনিও তো কথা বলেছেন লোকটার সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে তো ! ব্যকুল অমিয়দার চোখ কবিদা'কে খোঁজে। হ্যাঁ ঐতো, কবি'দা হাতে ধরা একটা কাগজ দেখে কবিতা শোনাচ্ছেন তপশ্রীদিকে। 

"অনেকে খুঁজেও মানুষ পেলাম না -
আজ যে ভালো কাল সে মন্দ 
স্বার্থ গেলেই দু'চোখ বন্ধ - 
মানুষ মারার ফাঁদ পেতেছে 
মানুষেরই গড়া কারখানা। 
মনের মতো মানুষ পেলাম না। 

আমি চোখ বুজলেই মাকে দেখি -
সত্যি তিনি, বাকিরা মেকি 
এমন করে থাকব নাকি 
বাঁচা-মরার দোটানায় -
মনের মত মানুষ পেলাম না। 

কারোর ঘরের মেয়েরা মরে 
নিপীড়িত হ'য়ে কিংবা জ্বরে 
মায়ের বুকে ফাটল ধরে 
কারণ, সেই তো জন্মের ঠিকানা। 
মনের মত মানুষ পেলাম না।।

ডাক্তার, কবি'দা, তপশ্রী - সবাই রয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সত্যি হয়ে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে ফেরিওয়ালা - তার হাহাকার আজ আমার বুকে এতো বেশি বাজছে কেন ?

একই হাহাকার কি আজ আমার কানে ফিরে আসছে? আমার ভাইয়ের সেই শেষ উচ্চারণ - 'দাদা, আমাকে বাঁচা দাদা। টাকা না দিলে হসপিটাল ট্রিটমেন্ট করবে না বলছে। পিঙ্কি আর পুতুল যে বাঁচবে না রে ......... 
সঞ্জয় আর দাঁড়ায় নি। কান্না আর আর্তনাদের খাদে হারিয়ে গেছে সঞ্জয় আজ কুড়ি বছর হলো। 

কোথা থেকে প্রবল শব্দ আসছে, বিরাট জলোচ্ছ্বাস - আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।  আমার বাড়িটা ক্রমশ ছোট হয়ে হারিয়ে গেল। উথাল-পাথাল আমি ঘুরপাক খাচ্ছি। ফেরিওয়ালা, তুই আর একবার আয় আমার কাছে, শেষবারের মতো। তুই কি সত্যি হতে পারিস না ? আমার স্টেরয়েড চাই। তুই আয় ভাই ফেরিওয়ালা, দাদাকে ঋণশোধটুকু করবার সুযোগ দে...... একবার ....... অন্তঃত শেষবারের মতো। 

১৯ মে ২০২১



Comments

  1. আজ লিখছি আগে পড়েছি শুধুই কেঁদেছি একা।আজ তো তুমি অসাধ‍্য সাধন করেছো তপনদা। এখন যেখানে আছো। ফেরিওয়ালার দেখা ও পাবে। শুধু আমার জন‍্য আর একবার পাঠাও তাকে। 🙏💖

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১