সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-১) | Sabujdweeper Diary Ep#1
একটি ভ্রমণ-কাহিনী
"সবুজদ্বীপের ডায়েরি"
(আন্দামান পর্ব-১)
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 24th February 2020 । রাত ১০টা ........
আজ সকাল ৮/৩৫-এর বিমানে এসে পৌঁছলাম পোর্ট ব্লেয়ার। অনেকের মুখেই আন্দামান ভ্রমণের সুখস্মৃতির ছবি দেখেছি। আমার আজ সেখানে বেড়াতে যাওয়া। সঙ্গী আমার স্ত্রী স্বপ্না আর এখন নিকট-আত্মীয়ের মতো হয়ে যাওয়া অরুণদার পরিবার। আমার ছেলে বুবলু বেড়াতে এতো ভালবাসে, কিন্তু কাজের চাপ থাকায় আসতে পারল না - আন্দামানে বুবলুর অভিমান জমা পড়ল। গত বছর থেকে আমার মায়ের বেড়ানোটাও সীমিত হয়ে পড়েছে নানারকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতায়। এতো ইচ্ছে আমি এবং আমার স্ত্রী যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো - তবু বয়স বাধ সাধল, আমার ৮৪'র মা।
মনটা মায়ের কারণে কিছুটা কলকাতা, আর ছেলের কারণে বোম্বেতে রেখে চোখ ফেরালাম বিমানের জানলায়। দূরের বিন্দুসম সবুজ দ্বীপগুলো ক্রমশঃ মনটাকে গ্রাস করতে লাগল। বাঙালির ভ্রমণ-পিপাসু মন ভিজতে শুরু করল। প্লেনে বসবার সিটগুলো ঠিক পাশাপাশি পাওয়া গেল না। অরুণদা আর আমি পাশাপাশি - একটু আগের সিটে পরপর তৃপ্তিবৌদি (অরুণদার স্ত্রী) আর স্বপ্না। প্রাকৃতিক নৈসর্গের আহ্বানে অরুণদা ফোন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাশের জানলায় - পুরো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে মুহূর্তে বেঁধে ফেলবার বাসনায়। জানলার ধারে প্রকৃত সিটের মালিক আত্মসমর্পণ করল অরুণদার আগ্রাসী উত্তেজনার কাছে - উনি একপেশে হয়ে পড়লেন।
নামলাম পোর্ট ব্লেয়ার এয়ারপোর্টে। মূলতঃ তৃপ্তিবৌদি আর স্বপ্নার উদ্যোগেই চারমাথা এক হলাম কুন্ডু স্পেশালের হাত ধরে এই সফরে। এয়ারপোর্টে তৎপর দুই ম্যানেজার নির্বিঘ্নে হোটেলে পৌঁছে দিল - শুনলাম আশিস ও রঞ্জিত - বছর চল্লিশ বয়সের এই দুই সারথিই আমাদের এই সফরের পথপ্রদর্শক। দুজনকেই মনে ধরল। হোটেলে স্নান ও কুন্ডুর স্পেশাল মধ্যাহ্নভোজনে আরামপ্রবণতা প্রশ্রয় পেল - ঘন্টা দুয়েক নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম। এরা আমাদের জন্যে মোট তিনটে ছোট ট্রাভেলার বাসের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এই সফরে মোট বিয়াল্লিশ জন ভ্রমণার্থী। পঁচিশের নিচে জনা পাঁচেক - তার মধ্যে একটি সদ্য-বিবাহিত দম্পতি - ছোট কেউ নেই। প্রাপ্তবয়স্করা নির্ভরতার আশ্বাসে পথে নেমেছেন কুন্ডু স্পেশালের হাত ধরে। ঘরোয়া পরিবেশ প্রবাসেও অতিমাত্রায় বিদ্যমান তাদের ব্যবস্থাপনায়। সন্ধেবেলা আমরা বেড়াতে গেলাম সেলুলার জেলের কাছে 'বীর সাভারকার পার্ক'-এ। তারপর নিয়ে যাওয়া হলো সেলুলার জেলের ভিতরে 'লাইট এন্ড সাউন্ড' দেখাতে।
ভারতবর্ষের কয়েকটি বিখ্যাত Light N Sound শো-এর মধ্যে প্রথম সারিতে পড়ে আন্দামান সেলুলার জেলেরটি। গা ছমছমে প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ত্রিভুজাকৃতি এক খোলা মাঠে এসে পৌঁছলাম। ১৮৯৫-৯৬ সালে তৈরী হতে শুরু হওয়া এই সেলুলার জেল, এক কথায় ভারতের বীরসন্তানদের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মৃত্যুগাথার মর্মান্তিক দেওয়াল লিখন। এই Light N Sound দেখতে দেখতে বা শুনতে শুনতে অনুভব করছিলাম ব্রিটিশ অত্যাচারের নৃশংসতা। পাশবিক নির্যাতন আর কঠোর অনুশাসনের প্রকোষ্ঠে বিদ্রোহের দাবানল। সারাদিনে এক কাপ চালের ভাত আর তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বরাদ্দ মাত্র ২ কাপ জল, প্রতি কয়েদীর ভাগ্যে। সেখানেও কৃপণতা - যদি কয়েদীর মানসিক দৃঢ়তা প্রথম জেলার ডেভিড ব্যারির সহ্যসীমাকে অতিক্রম করে। আমাদের পূর্বসূরীর আত্মত্যাগ ও দেশের প্রতি দুর্বলতাকে সঙ্গী করে ফিরলাম হোটেলে। ডিনার তৈরিই ছিল, একেবারে খেয়েদেয়ে যে যার ঘরে আশ্রয় নিলাম।
আমি শুরু করলাম এই ডায়েরি লেখা - যার নাম দেওয়া যাক "সবুজদ্বীপের ডায়েরি"। ঘুম ঘুম পাচ্ছে - রাত প্রায় ১টা বাজতে চলল। কাল সকালেই হ্যাভলক যাওয়া - রাধানগর বীচে সমুদ্রস্নান। শেষ করলাম আজকের লেখা। মন এখন মনমরা। চার ফুট ঘরের মধ্যে দশ বছরের টানা নৃশংস অত্যাচারিত জীবনসংগ্রাম - সেই ইতিহাসের পাতাতেই চোখ পড়ে আছে। যে চোখ কারোর জন্যে আরামের, কারোর বা চিরশান্তির।
বীর সাভারকার পার্কে প্রথমদিন সন্ধেবেলায় |
©tapanbasu
all image clicks : tapanbasu(author)
Comments
Post a Comment