বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১৮) | Baro Bismay Jage Ep#18

বড়ো বিস্ময় জাগে 
পর্ব-১৮

আঘাত আমাদের জীবনকে চেনায়। সুখ-দুঃখের সাথে মিলেমিশে থাকা মানুষগুলোর স্ব-রূপ প্রকাশ পায় যখন আমরা প্রকৃত বিপদে পড়ি। কিন্তু মানসিক আঘাত আর বিপদে বিপর্যয়, সব ক্ষেত্রে এক নাও হতে পারে।মাতৃহারা বালক রবির বয়স কম, হাল ধরলেন জ্যোতিদাদার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। কিন্তু মায়ের অভাব কি তাতে ঘুচতে পারে? সেও যদি বা প্রৌঢ় বয়সে হতো, নয় কথা ছিল। এ তো নিতান্তই নাবালক রবির প্রথম আঘাত - মৃত্যুর প্রথম কড়া নাড়া - সন্তানের সবচাইতে জোরালো খুঁটিটিতে। সেই বোধ হয় শুরু ! আঘাত যে কতবার কতভাবে এসেছিল রবির জীবনে ? 
তিনি লিখেছেন, 'প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে'। 
অথচ আঘাতে বলছেন, 
'সুখের বাধা ভেঙে ফেলে তবে আমার প্রাণে এলে  -
বারে বারে মরার মুখে অনেক দুখে নিলেম চিনে'। 
আঘাত পেয়ে এমন উপলব্ধির মননটাই তো অদৃশ্য থাকবার কথা। তাঁর আঘাতপ্রাপ্তির তালিকায় কয়েকটি তার অবচেতনে ছিল, কিছুটা এতটাই আকস্মিক যে অন্য যে কেউ দিশেহারা  হয়ে পড়তে পারতেন। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথ ! অন্য ধাতুতে গড়া। 

ধরুন না, পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন পালন। পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করা মাত্র দিকে দিকে তাঁর জন্মদিন পালনের নানা আয়োজন চলে প্রায় এক বছর কাল ধরে। শান্তিনিকেতনে পঞ্চাশতম বছরের জন্মোৎসব উদযাপনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে মূল অনুষ্ঠানটি হয় টাউন হলে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ২৮শে জানুয়ারী রবিবার ১৯১২ সালে। এদিকে সেই রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালন নিয়ে তৈরী হয়ে গেল বিরোধী গোষ্ঠী - যারা এই উৎসবে এতটাই বিমুখ হয়ে পড়লেন যে একটি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে দিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকেও পাঠালেন তার একটি কপি। অত্যন্ত যন্ত্রণাহত রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখলেন, '.......ভগবানের কৃপায় আমি সত্য মিথ্যা অনেক নিন্দা জীবনে বহন করিয়া আসিয়াছি। আমার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হইবার মুখে আর একটি নিন্দা জন্মদিনের উপহার হিসেবে লাভ করিলাম যে আমি আত্মসম্মানের জন্য লোলুপ হইয়াছি। .... বিরোধীপক্ষ তদ্বির করেন যাতে রবীন্দ্রনাথ নিজে এই আমন্ত্রণ অস্বীকার করেন। 
এতো কিছু সত্ত্বেও টাউন হলে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় ২৮শে জানুয়ারিতে। আমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল বিকেল ৪টের সময় অনুষ্ঠান শুরুর কথা। কিন্তু তার বহু আগে থাকতেই মানুষজন ভীড় করেন সভাস্থলে। কিন্তু মজার কথা হল এখানেও বিরোধী দল সে সভা বয়কট করলেন। প্রবাসী পত্রিকা লিখছে, টাউন হলে এইরূপ জনতা হয়েছিল যে যারা একটু অল্প বিলম্বে এসেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই আর প্রবেশ করতে পারেন নি। হয় বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নয় ফেরত চলে গিয়েছিলেন। প্রবাসীর ফাল্গুন সংখ্যা যতই রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা নিয়ে দীর্ঘ বিবরণ পেশ করুক না কেন, বিরোধীরা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না যে টাউন হলে তো সংবর্ধনা হল। তবে আবার করে বঙ্গীয় পরিষদের অনুষ্ঠান করবার কি দরকার ? প্রবল একচোট সমালোচনা হল। এমনি এক বিরোধী পদ্মনাথ ভট্টাচার্য টাউন হলের সংবর্ধনা উদযাপন কমিটির সম্পাদক রামেন্দ্রাসুন্দরকে একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠান। রামেন্দ্রসুন্দর কড়া প্রত্যুত্তর করেন, '......তিনি (রবীন্দ্রনাথ) বহু বৎসর সাহিত্যের যে উপকার করিয়াছেন তাহা মোটেই সামান্য নহে - এ বিষয় কোন মতভেদ নাই। কাজেই তাঁর প্রতি কিঞ্চিৎ সম্মানপ্রদর্শনে পরিষদের অপরাধ হইয়াছে বলা উচিত নহে। তদুপরি, এই অনুষ্ঠানে পরিষদের এক পয়সাও ব্যয় করিতে হয় নাই। কবির গুণমুগ্ধ আত্মীয়-বন্ধুরাই চাঁদা দিয়েছেন এই আয়োজনে।  ..... আমাদের কতিপয় বন্ধু কলিকাতায় থাকিয়াও এবং সমুদয় তথ্য জানিয়াও কেন যে এইরূপ আন্দোলন উপস্থিত করেন, তা আমাদের বোধগম্য নহে। .......
খুব ইচ্ছে করছে, রবিজীবনীকার প্রশান্ত পাল মহাশয়ের দেওয়া কয়েকটি চাঁদার অংকের তথ্য তুলে ধরতে। আমি নিশ্চিত, পাঠকের খুব ভাল লাগবে। 

শ্রীযুক্ত -
জগদীন্দ্রনাথ রায় ৫০০ টাকা 
লালগোলার মহারাজা ১৫০ টাকা 
চিত্তরঞ্জন দাশ ১০০ টাকা 
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ১০০ টাকা 
জগদীশচন্দ্র বসু ১০০ টাকা 
ডাঃ নীলরতন সরকার ৫০ টাকা 
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ৫০ টাকা 

সেই টাউন হল সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে সীতাদেবী লিখছেন, "..........বিরাট টাউন হল যখন করতালির শব্দে টলিতে লাগিল, তখন বুঝিতে পারিলাম রবীন্দ্রনাথ আসিতেছেন। মঞ্চের উপর আসিয়া না বসা পর্যন্ত তাঁকে দেখিতেই পাওয়া গেল না"। 

এক অনন্য সম্মানের নজির তৈরী হল টাউন হল ও তার পরবর্তী প্রত্যেকটি সংবর্ধনা সভায়, বিরোধীদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। টাউন হলে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তর অভিভাষণে কি বললেন ?
...........'আপনাদের প্রদত্ত এই সম্মানের উপহার ....... দেশের আশীর্বাদের মত। ইহা পবিত্র সামগ্রী, ভোগের পদার্থ নহে। ইহা আমার চিত্তকে বিশুদ্ধ করিবে, অহংকারকে আলোড়িত করিবে না'......
সম্মান গ্রহণেও কি গভীর দর্শন ! আশ্চর্য !!
এর ঠিক পাঁচ বছর আগে ১৯০৫-এর ২৫শে বৈশাখ কবি শান্তিনিকেতনে ছিলেন - দিনটা ছিল সোমবার। ৪৫ বছরের জন্মদিন পালনের সেরকম কোন খবর পাওয়া যায় না। তবু ২৩শে বৈশাখ মোহিতচন্দ্র সেনকে কবি শান্তিনিকেতনে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। আর কবির অন্য আরো একটি চিঠি পাওয়া যায়, যেটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে লেখা তাঁর চিঠির প্রত্যুত্তর। কি ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের লেখা চিঠিতে ? তাঁকেও বোধ হয় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং সেটা হয়তো একটু বড়সড় অন্যায়ই হয়ে থাকবে। নইলে ডি এল রায় এমন চিঠি লিখবেন কেন ? যাতে রবীন্দ্রনাথের মত স্থির চিত্ত এতটাই আঘাত পাবেন !

রইল তোলা সে চিঠির কথা, পরের পর্বে জন্যে। 

'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৮/চলবে ..........

'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (১৯) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1)livemint (2)thestatesman (3)theprint (4)Cartoon-alber ashok

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু