বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১৯) | Baro Bismay Jage Ep#19
বড়ো বিস্ময় জাগে
পর্ব-১৯
'আঘাত' বস্তুটার সঙ্গে নামে আর ব্যবহারে আমরা কম-বেশি সকলেই পরিচিত। তবে তার প্রকোপ একেক জনের কাছে একেক রকম হয়ে ধরা দেয়। কারোর কারোর ক্ষেত্রে সেই আঘাতের প্রভাব এতটাই হৃদয়বিদারক হতে পারে, যে তার মূল্য চোকাতে নিজের সহজাত মানসিকতা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিকে কখনও কখনও সরে আসতে হয়। রবীন্দ্রনাথ আভিজাত্যের চূড়ায় বসে চিরকাল তাঁর চিঠিপত্র ও নানা আলাপচারিতায় নিজের মনের কথা চূড়ান্ত ব্যক্ত করেছেন, বিনা দ্বিধায়। প্রয়োজনে প্রতিবাদের ভাষাতেও শক্ত হয়েছেন। কিন্তু আরেক সংস্কৃতি-মনস্ক সাহিত্য-সংগীত অনুরাগীর সঙ্গে পত্রাচারে ভাষার প্রয়োগে তাঁকে খুব রূঢ় হতে সচরাচর দেখা যায় নি। কিন্তু এবার কি হল ? রবিজীবনের পঁয়তাল্লিশতম জন্মদিনেও এমন দুর্দম আঘাতের বার্তাবহ চিঠি ! কার কাছ থেকে ? না, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাছ থেকে। কেমন সেই আঘাত ? যা এখানে প্রকাশ করা জরুরী ? আজকের পর্বে তা তুলে ধরছি এই জন্যেই যে তাঁর বিপুল খ্যাতির পরিমণ্ডলে অন্য খ্যাতিমান ব্যাক্তিবর্গেরও কতটা ঈর্ষাঘন শ্লেষ থাকতে পারে, সেও এক আশ্চর্যের উদাহরণ বটে।
বিজ্ঞাপনের কোন এক 'Tag Line'-এ দেখেছিলাম - "Neighbour's Envy, Owner's Pride" ......
রবীন্দ্রনাথকে যখন নিজের মনে করি তখন তাঁর গৌরবে তো আমিও গৌরবান্বিত - বাঙালি হিসেবে ...... Owner's Feel । আর বাকিদের ক্ষেত্রে ........
যুগে যুগে ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতার উদাহরণে কোন দাঁড়ি-কমা নেই। সে তার নিজের ধর্মেই আবহমান।
গুরুদেব ২৩শে বৈশাখ মোহিতচন্দ্র সেনকে পত্র দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর পঁয়তাল্লিশের জন্মদিনে শান্তিনিকেতনে আসবার জন্যে। এও লিখলেন, যাতে তাঁর কোন অসুবিধে না হয়, সেদিকে কবি দৃষ্টি রাখবেন। তাঁকে আরো বললেন, 'তুমি নিশ্চই এসো, কারণ ঝড়-বৃষ্টিগুলো মাঠেই মারা পড়ছে'।
কবির শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সেখানকার সান্ধ্য আড্ডা হত জমজমাট। অধ্যাপকেরা গুরুদেবের সঙ্গে বসে নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। চমৎকার আলাপচারিতায় সে সন্ধেগুলো বড়োই মনোহর হয়ে উঠত। আরো বড় কথা, রবীন্দ্রনাথ এ সমস্ত অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁকে যাঁরা গভীরভাবে জানতেন, তাঁদের কথায়, 'রবীন্দ্রনাথ একলা থাকতে বড়ো একটা পছন্দ করতেন না'। কবি চাইছিলেন বর্ষার প্রেক্ষাপটে জন্মদিনের সভায় মোহিতচন্দ্রের উপস্থিতি থাকুক।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
রবীন্দ্রনাথের লেখা লম্বা চিঠির কিছুটা অংশ তুলে দিলাম .......
........"আপনি আমার স্তাবকবৃন্দের দলে ভর্তি হইতে পারিবেন না এ কথাটা এতো জোরের সঙ্গে কেন যে বললেন আমি ভাল বুঝতে পারলেম না। 'আপনার নিন্দুকের দলে যোগ দিতে পারবো না', এ কথাও তো আপনি বলতে পারতেন। এ সমস্ত অনাবশ্যক কথা গায়ে পড়ে উত্থাপন করা কি জন্যে ?
স্তাবকতা বলতে যদি এই বোঝায় অন্যের ভালকে ভাল বলা, তবে আমার ক্ষেত্রে সে কাজে আপনি অক্ষম সেটি এত উগ্রতার সঙ্গে না বললেও কোন ক্ষতি হত না।
আপনার চিঠি থেকে এবারে এই বুঝলুম যে আমাদের পরিবারের সম্বন্ধে সাধারণের ধারণা যে আমরা অহংকৃত। এর বিপরীত ধারণার কথাও আপনারই ন্যায় ভাল লোকের মুখ থেকে শুনেছি। আপনি বলবেন, যাঁর কাছে শুনেছি তিনি স্তাবক। তা যদি হয়, তবে নিন্দার কথা যাঁরা বলেন তাঁরা যে নিন্দুক নন তা কেমন করে বুঝব ? আপনি আমার এবং আমাদের পরিবারের সম্বন্ধে আপনার মনের ভাব আমার ও সর্বসমক্ষে অকুণ্ঠচিত্তে ঘোষণা করতে পারেন, এই বলে আমাকে সতর্কও করে দিয়েছেন। ভাল -------
যামিনী রায়ের তুলিতে রবীন্দ্রনাথ |
আশ্চর্য ! রবীন্দ্রনাথের মত মানুষকেও জন্মদিনের আমন্ত্রণের উপহার এমন করেও পেতে হতে পারে !
এ পৃথিবীতে সব কিছুই বড়ো বিস্ময়ের। আমার এই কাহিনির বিচরণক্ষেত্র বেশিরভাগটাই রবিঠাকুরের নিজ-সৃষ্ট ঠাকুরদালান, সেখানে বার মাসে শুধু তাঁকে ঘিরেই কত যে পার্বণ ! যতটুকু সামান্য জেনেছি তাঁর, এ পৃথিবীতে তিনিও এক মহা-বিস্ময়। তবে স্বীকার করি, তাঁর সৃষ্টির সান্নিধ্যে এসে এক অপূর্ব শিক্ষালাভে আমার ব্যক্তিগত মনোকষ্টের ভার যে লাঘব হতে শুরু করেছে বেশ ছোট বয়স থেকেই, এ বিশ্বাস মনে বাসা বেঁধেছে। তাঁর মত যুগশ্রেষ্ঠকে যদি প্রতি পদে কলুষতা, নিন্দা, বিরোধিতা, ঈর্ষা ও প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে এ জন্মে আমার প্রতি তেমন কোন বিরুদ্ধাচরণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য শক্তি-সংগ্রহের প্রয়োজন নেই। ওই আকাশ-উঁচু সৃষ্টির বলয়ে প্রবেশ করে যেহেতু অ-সাধারণত্বের শিরোপা প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নেই, তাই আমার দুর্ভাবনারাও সুদূর নীহারিকা। জীবনে অনাহূত আঘাত থেকে আহত হবার ভয়-ভীতির নাগপাশ থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও যে সেই গুরুদেবের জীবনের মুহূর্তকথারই সৌজন্যে।
আজ এ পর্যন্তই।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৯/চলবে ..........
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (২০) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1)thehindu (2)awajdiyejai (3)artnet
Comments
Post a Comment