বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১৫) | Baro Bismay Jaage Ep#15

বড়ো বিস্ময় জাগে 
পর্ব-১৫


আজকের পর্ব রবিঠাকুরের লেখনীতে, ভারী মজার সেই প্রথম বিলেত যাত্রা। আমি শুধু একটু সংক্ষিপ্ত আকারে পরিবেশন করছি।
......."মেজোদাদার প্রস্তাবে এবং পিতৃদেবের সম্মতিতে ১৭ বছর বয়সে হঠাৎ বিলাত গিয়া পড়িলে একচোট হাবুডুবু খাইবার আশংকা ছিল। কিন্তু মেজোবৌঠাকরুন সেখানে ছিলেন, বিদেশের প্রথম ধাক্কাটা আর গায়ে লাগিল না।
কথা ছিল, পড়াশুনো করিব - ব্যারিস্টার হইয়া দেশে ফিরিব।
১৮৭৯ বিলেতে রবীন্দ্রনাথ
তাই একদিন ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হইলাম। অধ্যক্ষ আমাকে দেখিয়াই কহিলেন, 'What a splendid head you have'! এই ছোট কথাটা আমার মনে আছে কারণ বাড়িতে আমার দর্পহরণ করিবার জন্যে একজন অত্যন্ত উৎসুক ব্যক্তি আমাকে বুঝাইয়া দিয়েছিলেন যে, আমার ললাট ও মুখশ্রী বড়জোর কোনমতে মধ্যশ্রেণীর বলিয়া গণ্য হইতে পারে। এখন বিলাতবাসীর চোখে তাহার পার্থক্য দেখিয়া ভাবিতেছি, উভয় দেশের বিচারের প্রণালী কত ভিন্ন"!............

বিলেতে থাকাকালীন অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ঘটেছিল, সেগুলি হুবহু শুধুমাত্র পুনর্মুদ্রণ করবার ইচ্ছে না থাকায় কবির জীবনে যে শোচনীয় অথচ মজার ঘটনাটি ঘটেছিল, সেইটিই এবারে বলব - তবে আমার মত করে, ঘটনার আনুপূর্বিক সত্যতা বজায় রেখে।

১৭ বছর বয়সের ঐ বিলেত সফরে একটি প্রহসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিকে জড়িয়ে ছিল। সেটি যতটা হাস্যকর, ততটাই বেদনার। ভারতবর্ষের এক উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে বালক রবির আলাপ হল। তিনি স্নেহবশতঃ রবিকে 'রুবি' বলে ডাকতেন। সেই বিধবা রমণীর স্বামীর হঠাৎ মৃত্যু-উপলক্ষ্যে এক ভারতীয় বন্ধু একটি বিলাপ-গান লিখেছিলেন; বলাবাহুল্য,  সেটির উৎকর্ষ সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভাল। তার ওপর সেই বিলাপ-গানের নিচে উল্লেখ ছিল সেইটি বেহাগরাগিণীতে গাইতে হবে। মহিলা বললেন, 'রুবি, এইটি তুমি বেহাগরাগিণীতে গেয়ে আমাকে শোনাও'। সর্বনাশ ! তবু বালক রবি ভালোমানুষি দেখিয়ে গানটি গাইলেন। রবির কথায়, সেই অদ্ভুত কবিতার সঙ্গে বেহাগ সুরের সম্মিলনটা যে কেমন হাস্যকর হয়েছিল। ভাগ্যিস ! তা বোঝবার জন্যে সেখানে দ্বিতীয় কোন লোক ছিল না।  কবি ভাবলেন, এই বুঝি শেষ, এই শোচনীয় বেদনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল। 

কিন্তু না, রবির সাথে যে কোন নিমন্ত্রনসভায় দেখা হলেই মহিলা বলতে শুরু করেন, 'রুবি, এবার ওই গানটি গেয়ে শোনাও'। এবং তৎক্ষণাৎ তিনি পকেট থেকে এক টুকরো কাগজে লেখা ওই অদ্ভুত কবিতাটি সর্বসমক্ষে জাহির করতেন। নিমন্ত্রণসভায় উপস্থিত সকলে ভাবতো, বুঝি ভারতীয় সংগীতের এক অপূর্ব নমুনা এবার শোনা যাবে, এবং তাঁরা উৎসুক হয়ে রবির গানের অপেক্ষায় থাকতেন আর বালক রবির কান ক্রমশঃ লাল হয়ে উঠতো অজানা আশঙ্কায়। এদিকে না'ও বলা যায় না। আর যাই হোক, বিধবা রমণীর স্বামীর মৃত্যুশোকে যদি একটুও শান্তির জল বিতরণ করা যায়। যথারীতি সেই কাগজ বের হলো মহিলার পকেট থেকে। রবি বুঝতেন, এই শোকগাথার ফল তাঁর থেকে আরো খারাপ আর কারোর হবে না। গানের শেষে চাপা হাসির মধ্যে শুনতে পেতেন, 'Thank you very much, how interesting' ! ওই প্রবল শীতের মধ্যেও কবি দরদর করতে ঘামতে শুরু করতেন আর মনে মনে ভাবতেন, ওই ভদ্রলোকের মৃত্যু তাঁর পক্ষে কি করে এতো বড় একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো। 

ওই মহিলা থাকতেন লন্ডন থেকে কিছু দূরে। হয়তো রবির গান স্বামীহারা রমণীর হৃদয়ে এতটাই চরম তৃপ্তির উদ্রেক করেছিল যে, কবিকে প্রায় তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন। আর কবি কোন না কোন অছিলায় সেই অবশ্যম্ভাবী বিপদের ভয়ে কোনোমতেই সে পথে পা বাড়াতেন না। কিন্তু একদিন মস্ত অনুনয় করে টেলিগ্রাম এল - একবারটি আসতেই হবে। এদিকে দেশে ফেরার ডাক এসেছে। সুতরাং কবি ভাবলেন, 'শেষবারের মতো একবার দেখা করেই যাই'। 

সেদিন বড়ো শীত, বরফ পড়ছে, কুয়াশায় আচ্ছন্ন আকাশ। কলেজ থেকে বাড়ি না ফিরে কবি স্টেশন গেলেন। মহিলার বাড়ি একদম শেষ স্টেশনে। তাই নিশ্চিন্তে একটি বই মুখে জানলার ধারের সিটে বসলেন। শেষ স্টেশন, তাই কখন স্টেশন পার হয়ে যায় তার ভয় নেই। একের পর এক স্টেশন আসে আর একে একে কামরার সব যাত্রীরা নেমে যায়। এক সময় কামরা ফাঁকা হয়ে গেল। কবি লক্ষ্য করলেন, গন্তব্য স্টেশনের ঠিক আগের স্টেশন ছেড়ে ট্রেন এগিয়ে চলল, তারপর একজায়গায় থেমে পড়ল। বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কোন স্টেশন নেই, লোক নেই, আলো নেই, কিছু নেই। কবি ভাবলেন, ট্রেনের এই এক বদ স্বভাব। অস্থানে-কুস্থানে কথা নেই, বার্তা নেই, দাঁড়িয়ে পড়ে। আশেপাশে কাউকে দেখা গেল না যে জিজ্ঞেস করবেন। যাই হোক, তিনি আবার বই-এ মনোনিবেশ করলেন। ইতিমধ্যে হল কি, ট্রেন আবার উল্টো অভিমুখে চলতে শুরু করল। এবার তো আর নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায় না !

যখন দেখলেন সেই আগের ছেড়ে যাওয়া স্টেশনে ট্রেন আবার এসে দাঁড়িয়েছে, তিনি নেমে পড়লেন এবং জিজ্ঞেস করে জানলেন সে রাত্রে আর ট্রেন নেই। আশপাশে পাঁচ মাইলের মধ্যে কোন সরাইখানাও নেই যে রাত কাটানো যাবে। অগত্যা আবার স্পেন্সরের "Data of Ethics"-এ মন দিলেন। সকাল থেকে না খাবার, না জল - কিছুই জোটে নি। 

লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ
হঠাৎ এক পোর্টার এসে খবর দিল একটি স্পেশাল ট্রেন আসছে এবং অবশেষে ক্লান্ত দেহ নিয়ে কবি সেই ট্রেন ধরে বিধবা রমণীর বাড়ি পৌঁছলেন রাত সাড়ে ন'টায়। তখন বাড়ির নিমন্ত্রিতদের ডিনার শেষ হয়ে গিয়েছে। কবি ভাবলেন, এই দেরি যেহেতু ইচ্ছাকৃত নয়, তাই খাদ্যের কোন অভাব হওয়া উচিত নয়। মহিলা বললেন, 'এ কি রুবি ? এতো দেরিতে ? যাই হোক এসো, এক পেয়ালা চা খেয়ে নাও'। সেই খালি পেটে চা'ই সই। রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন, হয়তো পরে বাকি পদও মিলবে। তিনি লক্ষ্য করলেন, ঘরে অনেক সুন্দরী প্রাচীনা নারীরা রয়েছেন এবং ঐদিনের অনুষ্ঠান ছিল ওই রমণীর যুবক ভ্রাতুস্পুত্রের প্রাক-বিবাহ উদযাপন। মহিলা বললেন, 'চলো রুবি, একটু নৃত্য করা যাক'। দুটি বিস্কুট আর এক কাপ চা পেটে নিয়ে প্রাচীনা রমনীদের সঙ্গে নাচবার একটুও বাসনা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। তবু সেই ভদ্রতা ! আসলে ভালোমানুষেরা জগতে সময়-অসময়ে প্রয়োজনের থেকে বেশি ভালোমানুষির দ্বারা অসাধ্য-সাধন করে। সুতরাং নাচও হল। এই সময়ে সেই নিমন্ত্রণকর্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, 'রুবি, রাত অনেক হয়েছে। এর পর আশেপাশের সব সরাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছে যাওয়া কর্তব্য। তাঁরই বাড়ির কাজের লোক বালক রবিকে সরাই অবধি পৌঁছে দিল। সৌজন্যের কোনই অভাব ছিল না - ছিল না শুধু খাবার। মনে মনে ভাবলেন, শাপে বর হল - সরাইতে অন্তত খাবার নিশ্চই পাওয়া যাবে ! কবি জিজ্ঞেস করলেন, আমিষ-নিরামিষ-তাজা-বাসি কোনরূপ খাবার পাওয়া যাবে কিনা। সরাইয়ের মালিক উত্তর দিলেন, 'মদ যত খুশি পাওয়া যেতে পারে, খাদ্য একটুও নয়'। 

সকালবেলায় সেই মহিলা আবার ডেকে পাঠালেন, ব্রেকফাস্ট করবার জন্যে। না বলবার কোন প্রশ্নই নেই। কবি ছুটলেন এবং পেলেন গতরাতের ভোজের অবশেষ আজ ঠান্ডা অবস্থায়। এ'টুকু যদি কাল গরম অবস্থায় পাওয়া যেত, তাহলে পৃথিবীর কোথাও কোন গুরুতর ক্ষতি হত না ! 

ক্ষতির আশংকা তখনও যায় নি এবং সেটা কবি অনুমানই করতে পারেন নি। 

মহিলা বললেন, 'আসলে যাঁকে গান শোনাবার জন্যে তোমাকে ডেকেছি তিনি খুব অসুস্থ, শয্যাগত। তাঁর শোবার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তোমায় গাইতে হবে'। গৃহিনী বন্ধ দরজার দিকে নির্দেশ করে কবিকে গাইতে বললেন এবং ওই সেই গান। 

অদৃশ্য রহস্য-শোকের উদ্দেশে বন্ধ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ গাইলেন বেহাগরাগিণীতে সেই গান। তারপরে ওই রোগিণীর অবস্থা কি হয়েছিল সে খবর রবীন্দ্রনাথ পান নি, আমিও জানি না।  

লন্ডনে ফিরে দু-তিনদিন কবি বিছানা ছাড়েন নি। লন্ডনের বাড়ির মেয়েরা বললেন, 'দোহাই রবি, এই নিমন্ত্রণের আয়োজনকে আমাদের দেশের আতিথ্যের নমুনা হিসেবে গ্রহণ কোরো না'।

আসলে, চূড়ান্ত রসবোধসম্পন্ন না হলে এতো সুন্দর করে নিজের জীবনস্মৃতিতে এই কাহিনি পরবর্তীকালে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। আমি বিস্মিত হই প্রতিমুহূর্তে, রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি সাংস্কৃতিক মুন্সিয়ানায়। তাই তাঁকে ঘিরেই নানা বিস্ময় নিয়ে এই "বড়ো বিস্ময় জাগে" ধারাবাহিক। আমার মনের ভাললাগাকে, বাংলার সংস্কৃতির সবচাইতে বড় বটবৃক্ষটি নিয়ে গল্প করার প্রয়াসে এই কলম। খুব উপভোগ করছি আপনাদের সঙ্গে এই সাহিত্য-বিনিময়। 

আগামী পর্বে আবার অন্য বিস্ময়। 

'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৫/চলবে ..........

'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (১৬) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1-2)

Comments

Popular posts from this blog

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১