বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১৬)|Baro Bismay Jage Ep#16
বড়ো বিস্ময় জাগে
পর্ব-১৬
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র আজকের পর্বে বলব ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের নারীদের কথা।
প্রিন্স দ্বারকানাথের সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ি যেন বাংলার নবজাগরণের পূর্ব-দুয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল - দায় নিয়েছিল বাংলাসহ সারা দেশের ঘুম ভাঙাবার। এই পর্বে নারীজাতির মানসিকতায় এক সমূহ উত্তরণ ঘটে এবং সেখানে ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলব 'কাদম্বরী দেবী'র কথা - রবিঠাকুরের 'নতুন বৌঠান'। এছাড়াও ছুঁয়ে যাব আরও কয়েকজন মহিয়সী নারীকে, আমার রবিঠাকুরের প্রতি বিস্ময়-লেখনীর বিভিন্ন বাঁকে। এই নারীরা এক গোঁড়া হিন্দুবাদী সমাজের মধ্যে থেকেও ঠাকুরবাড়িতে স্বর্ণযুগের ভিত্তি স্থাপন করতে অগ্রণী ছিলেন।
ভোর অন্ধকার - সূর্যের আলো তখনো আকাশ পেরিয়ে মাটিতে নামেনি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মূল প্রবেশদ্বার পেরিয়ে পথে নামলো দুটি আরবি ঘোড়া। অশ্বারোহীদ্বয়ের একজনের দিকে তাকালেই চমকে উঠতে হয়। এই দু'জনের মধ্যে একজন তো নারী। হ্যাঁ, ইনিই কাদম্বরী দেবী - জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী - ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে বেড়াতে চলেছেন স্বামীর সাথে। ঠাকুরবাড়ির উচ্চাভিলাষ, উচ্চশিক্ষার প্রতি আকর্ষণ এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষের প্রথম আই.এ.এস বিলেতফেরত সত্যেন্দ্রনাথের বিলেতি আদবকায়দার প্রতি অনুরাগ - এই সমস্তের প্রভাবের মিশ্রিত ফল হয়তো উপরের ছোট্ট ঘটনাটি। কিন্তু তখনকার সময়ে এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়। পথিকরা তো অবাক, বিস্ময়ে নির্বাক, চোখ কপালে পড়শিদের। এ কী কান্ড ? আঁটোসাঁটো পোশাকে দৃপ্ত কাদম্বরীকে দেখবার ও হজম করবার চোখ বাঙালির তখনও তৈরী হয়ে ওঠেনি।
প্রাক-ঊনবিংশ শতকে মহিলাদের সাহিত্যানুরাগকে একটু হাসি ও অনুকম্পার চোখেই দেখা হতো। কিন্তু ঠাকুরপরিবারে মহর্ষিকন্যা স্বর্ণকুমারী এই প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে দিয়ে নারীপ্রগতির প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। বস্তুতঃপক্ষে, রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীকেই বলা যেতে পারে বাংলার প্রথম মহিলা সাহিত্যিক, যাঁর ঝুলিতে ছিল বেশ যথেষ্ট পরিমাণে গল্প-উপন্যাস ও নাটকের বিবিধ সম্ভার।
যদিও বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম উপন্যাসের স্রষ্টা কিন্তু কোন পুরুষ নন, এক নারীই - তাঁর নাম মোরাসাকি শিকিবু। ১০০০ থেকে ১০১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জাপানি এই সাহিত্যিকের লেখা "The Tale of Genji" বা "গেঞ্জি মনোগাতারি" জাপানের বা বিশ্বের প্রথম ক্লাসিক উপন্যাস।
ফিরে আসি স্বর্ণকুমারী দেবীর কথায়। স্বর্ণকুমারীর আবির্ভাবের পর সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মেয়েদের আত্মপ্রকাশের পথ বুঝি একটু সুগম হলো। কেন ? না স্বর্ণকুমারীর লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, গান, ভ্রমণকাহিনী - তৎকালীন যুগে এতোকিছু এক নারীর পক্ষে রচনা করা, যা একপ্রকার প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল, তার বহিঃপ্রকাশের বর্ণচ্ছটায় বাঙালি সমাজে স্বর্ণকুমারী দেবী অর্জন করলেন প্রার্থিত শ্রদ্ধা ও সম্মান। শৈশবেই তিনি পেয়েছিলেন মহর্ষির আশীর্বাদ - তাঁর একটি লেখা পড়ে পিতা মন্তব্য করেছিলেন, 'স্বর্ণ, তোমার লেখনীতে পুষ্প বৃষ্টি হউক'।
ঠাকুরবাড়িতে সে সময় সুবর্ণ যুগ চলছে। রয়েছেন স্বর্ণকুমারীর নাট্যরসিক দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যপ্রেমিকা স্ত্রী কাদম্বরী দেবী, রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা, এই স্বর্ণকুমারীকে অপেরাধর্মী গীতিনাটিকা লেখার পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের 'বাল্মীকি প্রতিভা' বা জ্যোতিদাদার 'মানময়ী'র আগেই রচনা করেন 'বসন্ত-উৎসব'।
এমন অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন গুণাবলীর আবহে নতুন কিছু করবার তাগিদ তো সর্বদাই থাকবে - সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এবার ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা মেতে উঠলেন এক নতুন পত্রিকা প্রকাশের জন্যে। তখন ঘরে ঘরে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শনের' সমাদর। এদিকে নতুন পত্রিকা প্রকাশে দুই ভাইয়ের দু'রকম মত। মহর্ষির বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্র একটু প্রাচীনপন্থী, তিনি চান 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকাকেই আরো জাঁকিয়ে তুলতে। নতুনের অভিলাষী জ্যোতিরিন্দ্রের অন্য ইচ্ছে। পুরনোকে নিয়ে নতুন নয়, একেবারেই আনকোরা নতুন পত্রিকা। শেষে তাঁর ইচ্ছেরই জয় হলো। নতুন পত্রিকার নামকরণ হলো "ভারতী"। ভারতীর প্রথম সম্পাদক হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। আর সেই প্রথম সংখ্যা থেকেই কিশোর রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন মাইকেল মধুসূদন রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র কঠোর সমালোচনা। প্রসঙ্গতঃ এই কাব্য প্রকাশ পায় ১৮৬১তে, রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষে। আর কি আশ্চর্য ! সেই কাব্যগ্রন্থেরই সমালোচনা 'ভারতী'র প্রথম সংখ্যায় - রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
ভাবা যায় ? তখন কতই বা বয়স ? ১৬ বছর ? সেটা তো ১৮৭৭ সালের কথা। এ সব একটু তলিয়ে ভাবলে বিস্ময় নানা কারণেই জাগে। যে সময়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বোধবুদ্ধি জাগ্রত হবার সময়, সে সময় বালক রবির একের পর এক অনন্য কীর্তি, যা আজকের দিনেও চর্চার বিষয়।
বিস্ময়ের আরো অনেক বাকি। পরের পর্বে অন্য কিছু ।
পর্ব-১৬
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র আজকের পর্বে বলব ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের নারীদের কথা।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
|
প্রিন্স দ্বারকানাথের সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ি যেন বাংলার নবজাগরণের পূর্ব-দুয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল - দায় নিয়েছিল বাংলাসহ সারা দেশের ঘুম ভাঙাবার। এই পর্বে নারীজাতির মানসিকতায় এক সমূহ উত্তরণ ঘটে এবং সেখানে ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলব 'কাদম্বরী দেবী'র কথা - রবিঠাকুরের 'নতুন বৌঠান'। এছাড়াও ছুঁয়ে যাব আরও কয়েকজন মহিয়সী নারীকে, আমার রবিঠাকুরের প্রতি বিস্ময়-লেখনীর বিভিন্ন বাঁকে। এই নারীরা এক গোঁড়া হিন্দুবাদী সমাজের মধ্যে থেকেও ঠাকুরবাড়িতে স্বর্ণযুগের ভিত্তি স্থাপন করতে অগ্রণী ছিলেন।
ভোর অন্ধকার - সূর্যের আলো তখনো আকাশ পেরিয়ে মাটিতে নামেনি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মূল প্রবেশদ্বার পেরিয়ে পথে নামলো দুটি আরবি ঘোড়া। অশ্বারোহীদ্বয়ের একজনের দিকে তাকালেই চমকে উঠতে হয়। এই দু'জনের মধ্যে একজন তো নারী। হ্যাঁ, ইনিই কাদম্বরী দেবী - জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী - ঘোড়ায় চড়ে ময়দানে বেড়াতে চলেছেন স্বামীর সাথে। ঠাকুরবাড়ির উচ্চাভিলাষ, উচ্চশিক্ষার প্রতি আকর্ষণ এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষের প্রথম আই.এ.এস বিলেতফেরত সত্যেন্দ্রনাথের বিলেতি আদবকায়দার প্রতি অনুরাগ - এই সমস্তের প্রভাবের মিশ্রিত ফল হয়তো উপরের ছোট্ট ঘটনাটি। কিন্তু তখনকার সময়ে এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়। পথিকরা তো অবাক, বিস্ময়ে নির্বাক, চোখ কপালে পড়শিদের। এ কী কান্ড ? আঁটোসাঁটো পোশাকে দৃপ্ত কাদম্বরীকে দেখবার ও হজম করবার চোখ বাঙালির তখনও তৈরী হয়ে ওঠেনি।
প্রাক-ঊনবিংশ শতকে মহিলাদের সাহিত্যানুরাগকে একটু হাসি ও অনুকম্পার চোখেই দেখা হতো। কিন্তু ঠাকুরপরিবারে মহর্ষিকন্যা স্বর্ণকুমারী এই প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে দিয়ে নারীপ্রগতির প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। বস্তুতঃপক্ষে, রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীকেই বলা যেতে পারে বাংলার প্রথম মহিলা সাহিত্যিক, যাঁর ঝুলিতে ছিল বেশ যথেষ্ট পরিমাণে গল্প-উপন্যাস ও নাটকের বিবিধ সম্ভার।
মোরাসাকির উপন্যাসে বর্ণিত Royal Outing Painting by Tosa Mitsuyoshi |
ফিরে আসি স্বর্ণকুমারী দেবীর কথায়। স্বর্ণকুমারীর আবির্ভাবের পর সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মেয়েদের আত্মপ্রকাশের পথ বুঝি একটু সুগম হলো। কেন ? না স্বর্ণকুমারীর লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, গান, ভ্রমণকাহিনী - তৎকালীন যুগে এতোকিছু এক নারীর পক্ষে রচনা করা, যা একপ্রকার প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল, তার বহিঃপ্রকাশের বর্ণচ্ছটায় বাঙালি সমাজে স্বর্ণকুমারী দেবী অর্জন করলেন প্রার্থিত শ্রদ্ধা ও সম্মান। শৈশবেই তিনি পেয়েছিলেন মহর্ষির আশীর্বাদ - তাঁর একটি লেখা পড়ে পিতা মন্তব্য করেছিলেন, 'স্বর্ণ, তোমার লেখনীতে পুষ্প বৃষ্টি হউক'।
স্বর্ণকুমারী দেবী |
এমন অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন গুণাবলীর আবহে নতুন কিছু করবার তাগিদ তো সর্বদাই থাকবে - সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এবার ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা মেতে উঠলেন এক নতুন পত্রিকা প্রকাশের জন্যে। তখন ঘরে ঘরে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শনের' সমাদর। এদিকে নতুন পত্রিকা প্রকাশে দুই ভাইয়ের দু'রকম মত। মহর্ষির বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্র একটু প্রাচীনপন্থী, তিনি চান 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকাকেই আরো জাঁকিয়ে তুলতে। নতুনের অভিলাষী জ্যোতিরিন্দ্রের অন্য ইচ্ছে। পুরনোকে নিয়ে নতুন নয়, একেবারেই আনকোরা নতুন পত্রিকা। শেষে তাঁর ইচ্ছেরই জয় হলো। নতুন পত্রিকার নামকরণ হলো "ভারতী"। ভারতীর প্রথম সম্পাদক হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। আর সেই প্রথম সংখ্যা থেকেই কিশোর রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন মাইকেল মধুসূদন রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র কঠোর সমালোচনা। প্রসঙ্গতঃ এই কাব্য প্রকাশ পায় ১৮৬১তে, রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষে। আর কি আশ্চর্য ! সেই কাব্যগ্রন্থেরই সমালোচনা 'ভারতী'র প্রথম সংখ্যায় - রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
ভাবা যায় ? তখন কতই বা বয়স ? ১৬ বছর ? সেটা তো ১৮৭৭ সালের কথা। এ সব একটু তলিয়ে ভাবলে বিস্ময় নানা কারণেই জাগে। যে সময়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বোধবুদ্ধি জাগ্রত হবার সময়, সে সময় বালক রবির একের পর এক অনন্য কীর্তি, যা আজকের দিনেও চর্চার বিষয়।
বিস্ময়ের আরো অনেক বাকি। পরের পর্বে অন্য কিছু ।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৬/চলবে ..........
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (১৭) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1) kolkatatrips (2)wikimedia (3)peoplepill
Image Courtesy >(1) kolkatatrips (2)wikimedia (3)peoplepill
Comments
Post a Comment