সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-২৩) | Sagarparer Diary (Episode-23)
সাগরপারের ডায়েরি
পর্ব-২৩ (অন্তিম পর্ব)
আজকের প্রসঙ্গ : ঘরে ফেরার গান
যে কোন অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শ্রোতাদের ভালবাসা ও সংগঠকদের সার্বিক তৃপ্তি। দুটোই আকণ্ঠ পান করলাম গতকাল অনুষ্ঠান শেষে। শ্রোতাদের বক্তব্য - 'এ অনুষ্ঠান আরো দু ঘন্টা চললেও আশ মিটতো না'। এই সব টুকরো টুকরো কথা ভাবতে ভাবতে মনের অগোচরে কখন নিদ্রা গিয়েছি। ঘুম ভাঙলো সকাল ৯টায়। অ্যালার্ম দেওয়া ছিল - কারণ আজ যে আমার দেশে ফেরা। আমার প্রথম আমেরিকা সফরে কাছে-দূরে পরিব্রাজন বা শপিং - সেই অর্থে কোনটারই সে রকম সুযোগ পেলাম না। আমার সাথে আজ শুভাশিষও ফিরবে। বাকিদের ফ্লাইট অন্য। ডঃ গুহ'র সঙ্গী হয়ে New York City বেড়াতে গেলাম আমি আর শুভাশিষ। আশেপাশের শহরদর্শনের ঈপ্সিত ইচ্ছে বোধ হয় ডঃ গুহ বুঝতে পেরেছিলেন। ইচ্ছের গোড়ায় জল দেবার একটু হলেও সুযোগ পেয়ে সানন্দে চেপে বসলাম ডঃ গুহ'র গাড়িতে।
আজ আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি।
'বহুদিন নিউ ইয়র্ক বা নিউ জার্সি'তে টানা এতক্ষণ এমন মুষলধারে বৃষ্টি হয় নি' - ডঃ গুহ বললেন।
John F Kenedy Airport-কে বাঁ'হাতে রেখে সমুদ্রপারে Statue of Liberty দেখতে গেলাম। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মেট্রোপলিটান শহর এই নিউ ইয়র্ক। আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল এই শহরে প্রায় ৮০০ ভাষায় কথা বলা মানুষের উপস্থিতি।
ডঃ গুহ'র সঙ্গে কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেলাম New York Harbour-এ অবস্থিত Statue of Liberty'র পাদদেশে। সেই ৩০৫ ফুট ১ ইঞ্চি দীর্ঘ মশালবাহী নারীমূর্তি সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে পৃথিবীকে আলো দেখাচ্ছে। আমার চোখের সামনে ইতিহাসের পাতাগুলো যেন উল্টে উল্টে যাচ্ছে। এই সেই Statue, যা কিনা ফ্রান্সের মানুষ একদা উপহার দিয়েছিল United States-কে। যে মূর্তির অবয়ব - রোমান স্বাধীনতার আরাধ্যা দেবীর আদলে তৈরী। ডানহাতে প্রজ্জ্বলিত মশাল আর বাঁহাতে আমেরিকার স্বাধীনতা-ঘোষণার তারিখ - জুলাই ৪, ১৭৭৬ - রোমান অক্ষরে লেখা পুস্তিকা। ভাস্কর্যটির ভিতরের কাঠামোটির নকশা ও তৈরি করেছিলেন ফ্রেড্রিক বার্থোল্ডি এবং গুস্তাব আইফেল, যিনি আইফেল টাওয়ারেরও নকশা করেছিলেন। মূর্তিটি এতটাই বিশাল যে তার ডান হাতে ধরে থাকা মশালের চারিপাশে যে ব্যালকনি - সেখানে পর্যটকরা উঠে পুরো নিউ ইয়র্ক শহরকে প্যানোরামার মত দেখতে পেতেন। এখন নানা কারণে ওই ব্যালকনিতে ওঠবার অনুমতি সরকার থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি আর রক্ষণাবেক্ষণের কারণে মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছানো গেল, তার বেশি আর এগোনো গেল না - লিফ্ট বন্ধ। সেখান থেকে আমরা চলে এলাম Manhattan-এ।
New York শহরকে বলা হয় বন্দর-শহর বা City of Harbors - বহু বন্দরের গা' বরাবর এই শহরের অবস্থান। এখানে Empire State Building দেখলাম। নিচে এক কফি-বারে কফি ও সামান্য স্নাক্স খেয়ে ফিরলাম নিউ জার্সি।
বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। এবার ফেরার পালা। নিশ্চিন্ত হলাম যে বৃষ্টির কারণে অন্ততঃ প্লেন ছাড়তে বিলম্ব হবে না। ঘরে ফেরার জন্যে মন যে ছটফট করছে। সেখানে সমস্ত চেনামুখই যে আমার প্রতীক্ষায়। আমার চোখ দিয়ে যে তাদের মার্কিন সফর ঘটবে। আসলে এই একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে বিদেশযাত্রাটা এত সহজলভ্য হয়ে পড়েছে যে আমাদের ঘরে ঘরে কেউ না কেউ হয় প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত নতুবা কার্যসূত্রে বিদেশে চাকুরীরত। আর এখন নানা লোভনীয় বিদেশভ্রমণের প্যাকেজ দিচ্ছে ট্রাভেল কোম্পানিরা। ফলে আমার ছেলেবেলায় যা ছিল কল্পনার অতীত, তা আজ 'বিদেশ যাওয়াটা কোন ব্যাপার নয়' স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার কাছে বিদেশী কোন সংস্থার আমন্ত্রণে তাদের দেশে আমার নিজের কাজের নমুনা পেশ করবার সুযোগ পাওয়াটা অনেক বেশি গর্বের বা আদর্শ-উপলব্ধির। কারণ যে পরিবারে আমি বড় হয়েছি, সেখানে বিলাসিতার কোন প্রশ্রয় ছিল না। তাই আজ আমার এই ভ্রমণ পরিবারের এক থেকে অনেকের সান্নিধ্য পাবে। সেই প্রতিক্ষাতেই মন বড়ো ব্যাকুল হয়েছে ।
সুপর্ণাদি আর ডঃ গুহ'র তত্ত্বাবধানে লাগেজ গুছিয়ে নেওয়া গেল। ডঃ গুহ বললেন - 'তপন, আমেরিকাতে এসেছো অরে লিমুজিন চড়বে না, তাই কি কখনো হয় নাকি ? আমি একটা লিমুজিন বুক করেছি, তুমি আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ো। আর হ্যা, দেশে ফিরে এই দাদা-দিদিকে ভুলো না। অবশ্যই মেইল পাঠিও '।
হঠাৎ পরিচয়ের এমন গভীর অথচ মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রবাসী উষ্ণতা - গোটা সফরটাই যেন তুলির টানে এক অপূর্ব ছবি হয়ে বাঁধা পড়ল বুকের গভীরে।
চমক ভাঙল স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে - 'স্যার, আর আধঘন্টার মধ্যে আমরা এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাব ; আপনার ফ্লাইট ক'টায়' ? আবার অবাক হবার পালা। জানলাম বাংলাদেশী এই যুবক ইংল্যান্ড প্রবাসী। ম্যানেজমেন্ট পড়তে আমেরিকায় এসেছে এবং পকেট মানি জোগাতে লিমুজিন চালায়।
ফেরার পথে আকাশপরীদের অনুকূল আতিথেয়তায় যথেষ্ট পরিমাণ উদরপূর্তি ও অন্যান্য ভাললাগার বাকি আয়োজনে ক্লান্ত শরীর আস্তে আস্তে ঘুমের আঁচলে গা ঢাকা দিল।
পিছনে সরে সরে যাচ্ছে সমুদ্রকুলের দু'হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানানো নিউ ইয়র্ক শহর, ঈশ্বরের নিজের হাতে সাজানো বাগান নিউ জার্সি - The Garden Estate । ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে যানবাহনের ভিড়ে হারাতে হারাতে কোনোক্রমে পৌঁছে যাওয়া সেই চেনা ঠিকানায় - যেখানে আপনজনের আশ্রয়ে আমার জীবনভ্রমণ।।
'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
Picture Courtesy > (1)wallpapersafari (2)youtube (3)facebook
যে কোন অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শ্রোতাদের ভালবাসা ও সংগঠকদের সার্বিক তৃপ্তি। দুটোই আকণ্ঠ পান করলাম গতকাল অনুষ্ঠান শেষে। শ্রোতাদের বক্তব্য - 'এ অনুষ্ঠান আরো দু ঘন্টা চললেও আশ মিটতো না'। এই সব টুকরো টুকরো কথা ভাবতে ভাবতে মনের অগোচরে কখন নিদ্রা গিয়েছি। ঘুম ভাঙলো সকাল ৯টায়। অ্যালার্ম দেওয়া ছিল - কারণ আজ যে আমার দেশে ফেরা। আমার প্রথম আমেরিকা সফরে কাছে-দূরে পরিব্রাজন বা শপিং - সেই অর্থে কোনটারই সে রকম সুযোগ পেলাম না। আমার সাথে আজ শুভাশিষও ফিরবে। বাকিদের ফ্লাইট অন্য। ডঃ গুহ'র সঙ্গী হয়ে New York City বেড়াতে গেলাম আমি আর শুভাশিষ। আশেপাশের শহরদর্শনের ঈপ্সিত ইচ্ছে বোধ হয় ডঃ গুহ বুঝতে পেরেছিলেন। ইচ্ছের গোড়ায় জল দেবার একটু হলেও সুযোগ পেয়ে সানন্দে চেপে বসলাম ডঃ গুহ'র গাড়িতে।
আজ আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি।
'বহুদিন নিউ ইয়র্ক বা নিউ জার্সি'তে টানা এতক্ষণ এমন মুষলধারে বৃষ্টি হয় নি' - ডঃ গুহ বললেন।
John F Kenedy Airport-কে বাঁ'হাতে রেখে সমুদ্রপারে Statue of Liberty দেখতে গেলাম। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মেট্রোপলিটান শহর এই নিউ ইয়র্ক। আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল এই শহরে প্রায় ৮০০ ভাষায় কথা বলা মানুষের উপস্থিতি।
![]() |
Statue of Liberty |
New York শহরকে বলা হয় বন্দর-শহর বা City of Harbors - বহু বন্দরের গা' বরাবর এই শহরের অবস্থান। এখানে Empire State Building দেখলাম। নিচে এক কফি-বারে কফি ও সামান্য স্নাক্স খেয়ে ফিরলাম নিউ জার্সি।
বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। এবার ফেরার পালা। নিশ্চিন্ত হলাম যে বৃষ্টির কারণে অন্ততঃ প্লেন ছাড়তে বিলম্ব হবে না। ঘরে ফেরার জন্যে মন যে ছটফট করছে। সেখানে সমস্ত চেনামুখই যে আমার প্রতীক্ষায়। আমার চোখ দিয়ে যে তাদের মার্কিন সফর ঘটবে। আসলে এই একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে বিদেশযাত্রাটা এত সহজলভ্য হয়ে পড়েছে যে আমাদের ঘরে ঘরে কেউ না কেউ হয় প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত নতুবা কার্যসূত্রে বিদেশে চাকুরীরত। আর এখন নানা লোভনীয় বিদেশভ্রমণের প্যাকেজ দিচ্ছে ট্রাভেল কোম্পানিরা। ফলে আমার ছেলেবেলায় যা ছিল কল্পনার অতীত, তা আজ 'বিদেশ যাওয়াটা কোন ব্যাপার নয়' স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার কাছে বিদেশী কোন সংস্থার আমন্ত্রণে তাদের দেশে আমার নিজের কাজের নমুনা পেশ করবার সুযোগ পাওয়াটা অনেক বেশি গর্বের বা আদর্শ-উপলব্ধির। কারণ যে পরিবারে আমি বড় হয়েছি, সেখানে বিলাসিতার কোন প্রশ্রয় ছিল না। তাই আজ আমার এই ভ্রমণ পরিবারের এক থেকে অনেকের সান্নিধ্য পাবে। সেই প্রতিক্ষাতেই মন বড়ো ব্যাকুল হয়েছে ।
![]() |
Limousine |
হঠাৎ পরিচয়ের এমন গভীর অথচ মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রবাসী উষ্ণতা - গোটা সফরটাই যেন তুলির টানে এক অপূর্ব ছবি হয়ে বাঁধা পড়ল বুকের গভীরে।
চমক ভাঙল স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে - 'স্যার, আর আধঘন্টার মধ্যে আমরা এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাব ; আপনার ফ্লাইট ক'টায়' ? আবার অবাক হবার পালা। জানলাম বাংলাদেশী এই যুবক ইংল্যান্ড প্রবাসী। ম্যানেজমেন্ট পড়তে আমেরিকায় এসেছে এবং পকেট মানি জোগাতে লিমুজিন চালায়।
ফেরার পথে আকাশপরীদের অনুকূল আতিথেয়তায় যথেষ্ট পরিমাণ উদরপূর্তি ও অন্যান্য ভাললাগার বাকি আয়োজনে ক্লান্ত শরীর আস্তে আস্তে ঘুমের আঁচলে গা ঢাকা দিল।
পিছনে সরে সরে যাচ্ছে সমুদ্রকুলের দু'হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানানো নিউ ইয়র্ক শহর, ঈশ্বরের নিজের হাতে সাজানো বাগান নিউ জার্সি - The Garden Estate । ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে যানবাহনের ভিড়ে হারাতে হারাতে কোনোক্রমে পৌঁছে যাওয়া সেই চেনা ঠিকানায় - যেখানে আপনজনের আশ্রয়ে আমার জীবনভ্রমণ।।
সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-২৩/সমাপ্ত ..........
'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
আমার অন্য আরেকটি পর্ব-ভিত্তিক রচনা "বড়ো বিস্ময় জাগে"র জন্য এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
এক সংগীত শিল্পী র লেখনীতে একটি ভ্রমণ কাহিনী।সঙ্গে পেলাম কিছু মনমুগগ্ধকরা ছবি।সুচারুরূপে বর্নিত লেখকের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা র কথা পড়ে আমরাও কখন নিজের অজান্তেই বিদেশ ভ্রমণ করে অনুষ্ঠানের সাক্ষী হলাম যেন। অপূর্ব অনুভূতি হল। হঠাৎই দেশে ফিরে যেন ঘোর কাটলো।এই অনাবিল আনন্দ যেন থেমে না থাকে। অনুরোধ রইল লেখক আবার ও যেন এঐভাবে আমাদের তার ঝুলি থেকে নতুন কিছু উপস্থাপন করেন খুব শিঘ্রই।🙏🙏🙏
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ।
Deleteএই ব্লগ আমার নিজের সৃষ্টিমূলক চিন্তাভাবনা প্রকাশের আশ্রয়স্থল। চেষ্টা করব নতুন নতুন ভাবনার উপাদান প্রতিনিয়ত তুলে ধরবার। আমার নিয়মিত পাঠক-শুভানুধ্যায়ী-সমালোচকরা ছাড়াও আরো অনেক নতুন বন্ধুকে পেলাম, যারা আমায় উৎসাহিত করেছেন নানাভাবে। সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই "সাগরপারের ডায়েরি" পুরোটা ধৈর্য ধরে আমাকে সহ্য করার জন্য।
ReplyDelete