একটু ভেবে দেখুন (পর্ব ৪)-বিজ্ঞাপন ও অবসাদ | Ektu Bhebe Dekhun-4

একটু ভেবে দেখুন 
পর্ব ৪
আজকের পর্ব - বিজ্ঞাপন ও অবসাদ 

অবসাদ

আজ বাংলার কথা আর এক বাঙালির কথা। এই পর্বে এই বাঙালিকে আমরা 'স্বপ্নিল' নামে চিনব। 

ছেলেবেলা থেকেই বই-পড়ার প্রতি দারুণ আগ্রহ। মুড়ির ঠোঙা থেকে মুদিখানার স্লিপ - তার বই-পড়ার লিস্টিতে কেউ বাদ যায় নি। হঠাৎ কেমন করে যেন রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি' হাতে এল। বালককে তো থামানো দায়। ওই বইয়ে যা যা উদাহরণ আছে, তার সব কিছুই এই মুহূর্তে জানা দরকার। তাগিদ তাকে সমগ্র রবীন্দ্রনাথ পড়িয়ে ছাড়ল। এবং সে সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠল - ধীরে ধীরে। শুরু হল গান শেখা, তারপর শাস্ত্রীয় সংগীত, স্বনামধন্য সুরকারের কাছে বাংলা গানের তালিম - এই সমস্ত কিছু নিয়ে সে হয়ে উঠল এক অন্য মানুষ। যে বুঝতে শিখল - আমাদের বাঙালির অহংকার করবার সত্যিই অনেক কিছু আছে, আর তার আসমুদ্র জ্ঞানভাণ্ডারে যদি সঠিকভাবে সঠিক গুরুর তত্ত্বাবধানে গা ভাসানো যায় - তাহলেই প্রকৃত মুক্তিস্নান। আর সে যত শিখতে লাগল, ততই অনুধাবন করতে শুরু করল, এ জ্ঞানসমুদ্র বাস্তবে অসীম - যতই শেখা যাক না কেন, আসলের তুলনায় তা কিছুই নয়। 

ব্যাস ! এই তার 'কাল' হল !
তাকে কেউ জ্ঞানী বলতে চাইলেই সে উত্তর দেয়, 'ধুর ! এ আর এমন কি ? আমি তেমন কিছুই জানি না, এখনো সেরকম কিছু শিখে উঠতেই পারলাম না'। অনেক কিছু শেখবার ও জানবার পরেও তার নিজের সম্পর্কে এই অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে অন্য লোকদেরও বিশ্বাস করতে শেখাল যে, স্বপ্নিল তেমন কিছু জানে না। তবুও তার কাছে খ্যাতিমান ও অখ্যাত - দু'ধরনের মানুষ ছাড়াও আরো কিছু ছাত্র-ছাত্রীর আনাগোনা। যদিও দিনের শেষে তাদের কৃতজ্ঞতা-স্বীকারের তালিকায় স্বপ্নিলের নাম অদৃশ্য। সেখানে জনপ্রিয় ও সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিত্বের আড়ম্বর-উপস্থিতি - যাদের সাথে পরিচয়ের গন্ডি খুব কম ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অতি সামান্য দিনের। 

খুব কাছের এক গায়ক বন্ধু, যার খুব নাম-ডাক ইদানিং - সেও মনে মনে স্বপ্নিলকে সম্ভ্রম করে, কিন্তু প্রকাশ্যে নিজেরই জয়গান গায় - 'ও আর এমন কি জানে ? ভাল লোকজনের কাছে একটু-আধটু গান-টান শিখেছে'। সেই বন্ধুটি আরো জানালে, 'এই ইন্ডাস্ট্রিতে ২০ বছর হয়ে গেল আমার। এতদিন ধরে নিজেকে Limelightএ রাখা চাট্টিখানি কথা ? নিজেকে বিজ্ঞাপনে রাখতে জানতে হয়, বুঝলি' ?

স্বপ্নিল তো কিছুই বুঝলো না। নিজের সামান্য জ্ঞান 'বিজ্ঞাপন' করে অসামান্য করবার তাগিদ সে কোনদিনই অনুভব করে নি। দিনে দিনে দেখা গেল - অল্প কিছু হিট গান, ভাল কথা বলতে পারা, এবং বাইরের আদব-কায়দায় বেশ একটা জ্ঞানী-গুণী ভাব আর ঝকঝকে স্মার্টনেস, এমন যোগ্যতাসম্পন্ন শিল্পী-সুরকার-বাদ্যযন্ত্রীরা যথেষ্ট শক্তপোক্ত জায়গা করে নিচ্ছে - কি মঞ্চে, কি টেলিভিশনে। এই শ্রেণীর শিল্পীদের নিজস্ব একটি পছন্দের দল আছে এবং তারা যে প্ল্যাটফর্মেই যাক না কেন, একে অন্যের ঢাক পেটায় বেশ সুচতুরভাবে - আমি বলতে পারব না, সেটা ঠিক কোন বিশ্বাস থেকে। ফলে, সাধারণের চোখে 'মধ্যমান' হয়ে ওঠে 'গডফাদার'। শহর ও শহরতলীর ভিড় বাড়ে গান শিখতে, মিডিয়ার উসখুসানি ইন্টারভিউ পেতে। অপূর্ব এক প্যাকেজিং। ভাল-মন্দ, জ্ঞান-অজ্ঞানের বিচারটাই অদৃশ্য। একই মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সর্বত্র। পাঁচনের মত খাইয়ে দেওয়া বিজ্ঞাপনের অভ্যাসে আমার-আপনার জীবনচর্চা। 'হাঁ' করে শুধু গিলে যাও - স্বাদগন্ধ রুমালে করে পকেটে ভরে রাখো।

স্বপ্নিল ভাবে, তার বেড়ে ওঠা জীবনে বেশ কিছু নাম মনে পড়ে, যারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ও বর্ণময় চরিত্র। কই? কাগজে, টিভিতে তাদের নিয়ে তো কোন মাতামাতি নেই ! যতক্ষণ না দেশি-বিদেশী  কোন সার্টিফিকেট বা পুরস্কার তার কপালে জুটছে - ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মিডিয়াতেই তার কোন উল্লেখ নেই। আর মিডিয়াতে থাকতে গেলেও তো একটু 'বুদ্ধিমান' হতে হয় ! শুধু যোগ্যতা দিয়ে যে তা পাওয়া যায় না, সেটা এই বয়সে এসে বেশ বুঝতে পারে স্বপ্নিল। প্রসঙ্গত, স্বপ্নিল এখন সিনিয়র সিটিজেন। এর মধ্যে তার নিজের লেখা-সুরকরা অন্তত হাজারখানেক গান তৈরী হয়েছে, যা বিদগ্ধজনের বিচারে অতি উৎকৃষ্ট। 

স্বপ্নিল এখন বিশ্বাস করে, পাঁচ-দশটা জনপ্রিয় কবিতা বা গান তৈরী তবুও করা যেতে পারে - কিন্তু দিনের পর দিন কণ্ঠকে যথাযত সংযমে রেখে একই দক্ষতায় ২৫-৩০ বছর গান গাইতে পারা কিম্বা প্রায় শ'খানেক মৌলিক কবিতা-গল্প লিখে কয়েক যুগ নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করে রাখাটা বেশ একটু কঠিন বটে। 

খুব ভয়ে ভয়ে  স্বপ্নিল একদিন আমায় বললে, আচ্ছা, গত বিশ বছরে তোকে নাড়িয়ে দিয়েছে এমন ২০টা বাংলা গান আমাকে বলতে পারিস ? ONLY ২০টা - যার মধ্যে গানের কথা, সুর, ছন্দের নতুনত্ত্ব তোকে ভাবিয়েছে? আমি তো রেডিও শোনাই ছেড়ে দিয়েছি, সেখানে সিংহভাগ জুড়ে শুধু হিন্দি গান। আমাদের নতুন বাংলা গানের নামগন্ধ নেই। যেটুকু সামান্য বাজে, তা ওই পুরোনো দিনের গান। আমার না খুব ইচ্ছে করে, নতুন কোন গান শুনে নেশায় বুঁদ হতে - কিন্তু পারি না রে ! খুব ইচ্ছে করে, কবিতা বা গানের কোন একটা লাইন বারবার আউড়ে যেতে 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো' গোছের কিছু যদি পাই। আজও অপেক্ষায় আছি, একটা মৌলিক নতুন গান নতুন শিল্পীকে চিনিয়ে দেবে ভবিষ্যতের পথে। ভাবিস না, আমি সেই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছি। আসলে নতুনকে গ্রহণ করতে চেয়ে তো প্রায় ৩০টা বছর কাটিয়ে দিলাম। আজ বাংলা সিনেমায় মনে রাখবার মত কোন গান নেই, গানের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা কোন ছবি নেই, টেলিভিশনেও নেই নতুন গানের কোনো শো। হ্যাঁ রে, সত্যি আজ আমার খুব ভয় করে। নতুনদের জন্যেই ভয় করে। ওদের জন্যে এই আমিই বা 'কি' রেখে যাচ্ছি ? আমাকে তো এখনই ভুলে যাওয়ার তালিকায় রেখেছে সাধারণ মানুষ, ব্রাত্য করেছে মিডিয়া বা অনুষ্ঠান সংগঠক - তাই আমার নিজের কথা প্রকাশ্যে বলে যাবারও কোন জায়গা নেই ! 

আজ কাঁচা বয়সের ছেলে-মেয়েরা বিজ্ঞাপন ও টিভিতে দেখা চেনা-মুখের কাছে ভিড় করছে গান শিখবে বলে, হয়ত সেই মঞ্চে সুযোগ পাবার আকর্ষণে। একেই বিজ্ঞাপন বলে। এই মুখ স্ক্রিপ্টের বাইরে কিচ্ছু বলে না, কারণ সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার আর নাও ডাক আসতে পারে। জলে নেমে কুমিরের সাধে যে বিবাদ করতে নেই - এই আপ্তবাক্য প্রথম দিন থেকেই এদের নখদর্পণে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই মুখ এখনো সুযোগই পায়নি বৃহত্তর আসরে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার - যে মুখ এখনও চিনিয়ে দিতে পারেনি নিজের সৃষ্টিকে আলাদা করে, অননুকরণীয় ভঙ্গিমায়। একজন Eye-Opener হয়ে ওঠবার মত কোন কাজ তারা হয়তো এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারে নি এ মুখেদের অনেকেই সংগীতের গভীরতম বিশ্লেষণে পারদর্শী নয় - তারাই আজকে বাঙালির সংগীতের চাবিকাঠি - তারাই তো আগামীর স্বপ্ন ! এদের কাছে গান শিখতে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরাই কিছুদিন পর হাল ধরবে বাংলা গানের - যেখানে সর্বভারতীয় কোন তালিম থাকবে না, থাকবে না সংগীতে কণ্ঠপ্রয়োগের মুন্সিয়ানার পথপ্রদর্শক, আশা করাটাও অন্যায় হবে মৌলিক তেমন কোন সংগীত-আয়োজনের - যেখানে সিম্ফনির সাথে হার্মনির তফাৎ বোঝা যাবে, প্রোগ্রেশন থাকবে কিন্তু ডিস্টর্শন কানে আঘাত করবে না - অথচ গানের বাণী ও সুরের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে যন্ত্রের পথচলা। Indian or Western - যে কোন গানে তেমন নিদর্শনই তো আজও আমাদের কানকে তৃপ্তি দেয়, শিল্পের সুষমায় মন ভরিয়ে রাখে, তাই না ? এটা যে Fine Arts !

আজ স্বপ্নিল ডিপ্রেশন-এর শিকার। কি যেন ভাবে একমনে - দৃষ্টিতে ধার আছে - কোন বহিঃপ্রকাশ নেই। মাঝেমধ্যেই উচ্চস্বরে 'হা-হা' করে হাসে আর বলে - "তোরা আজও একটা কবিতার 'লাইন' পেলি না রে ! পিঠের উন্মুক্ত বারান্দায় বাংলা ভাষাকে অশ্লীল করে আক্রমণ করতেও যে সেই তোদের রবীন্দ্রনাথকেই লাগে" !!! 

কানে হাত চাপা দিই, শিউরে উঠি আশঙ্কায়। স্বপ্নিলের কথাগুলো অনুরণন করে মাথার মধ্যে। কি জানি ! আমিও ডিপ্রেশনের স্বীকার হবো না তো ? হয়তো সে আমারি ভুল ! ছেলেমেয়েদের প্রকাশ্য হোলিখেলায় আমাদের শিল্পের প্রতি কদর্য ইঙ্গিত তো বিজ্ঞাপনেরই পোয়াবারো, তাই না ? 

সোনাঝুরি শান্তিনিকেতন

আমাদের আজকের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেন বিজ্ঞাপনের শিকার হয়ে আগামীর 'ডিপ্রেশন' না হয়। সেই পৃথিবী আমাদের কাম্য নয়। Fine Artsকে Superfine করবার দায়িত্ত্বটাও কিন্তু আমাদেরই। 

একটু ভেবে দেখবেন  !!!

(পুনশ্চ : 'স্বপ্নিল' একটি কাল্পনিক চরিত্র। আর এই লেখার সম্পূর্ণ দায় আমার। কোন সংগীত শিল্পী বা সংগীতের আঙ্গিকে কাজকর্মে জড়িত কোন মানুষকে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সুদীর্ঘ চার দশক বাংলা গানবাজনা নিয়ে সামান্য কাজ করবার সুবাদে আমার কিছু অনুভব, কিছু প্রশ্ন তুলে ধরতেই এই "একটু ভেবে দেখুন" ব্লগ-এর অবতারণা। ভেবে দেখলে ভাল, না দেখলে আরও ভাল - সেটা তার দায়, যিনি পড়বেন - আমার নয়।)

এই ধারাবাহিকের অন্য পর্বের জন্যে :-
"একটু ভেবে দেখুন" পর্ব-১
"একটু ভেবে দেখুন" পর্ব-৫


©tapanbasu.all rights reserved.
image courtesy : (1)footscraycounselling (2)condenasttravellorindia

Comments

  1. খুব ভালো লেখা।মন ছুঁয়ে গেলো।কিছু মানুষ আজ উনমত্ত শিল্পী হবার নেশায়। অথচ বেসিক শিক্ষা টাই হয়তো বা নেই।জানা বোঝাও দরকার নেই।একটু ভালো গাইছি তো লাখ লাখ টাকা বিজ্ঞাপন প্রোগ্রাম নিজের প্রচার করতে কোন বড় শিল্পীর সাথে স্টেজ করা Photoতোলা আরও কত কিতে অবাধে খরচ করে চলে অথচ ঘরে তার সংসার না খেতে পেলেও তাদের নজর থাকেনা।স্টুডিও আ‍্যপ এসব এর দৌলতে এডিটিং এর মাধ্যমে গানটা দাড়িয়ে গেল ঝা চকচকে মিউজিক এর ব‍্যবহারে গলার দূর্বলতা ঢাকা এঐ নিয়ে এখন শিল্পী র চলন।একটি গান দক্ষতা নিয়ে বুঝে ১০০বার গেয়ে শুধুমাত্র তানপুরাতে গাইতে বলো অমনি তারা কিন্ত নিভে যাবে।চটক চমক দিয়ে নাম যেমন সাময়িক হয় ঠিকই কিন্তু তা অকালেই ঝড়ে পরে ।কজন পারে আজ কিংবদন্তি শিল্পীহেমন্তদা মান্না দের মতো হতে। কজন পারে নিজের গান রচনা করে সুর করে মানুষের মনিকোঠায় দাগ রাখতে। তাই আজ ও তো রবীন্দ্রনাথ।🙏🙏🙏🙏
    পিউ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাল বলেছ । অনেক ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু