একটু ভেবে দেখুন - ১ - 'মা' [] Ektu Bhebe Dekhun Ep#1
একটু ভেবে দেখুন - ১ | তপন বসুর 'কলমে'
আজ : 'মা'
নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্তের সংসারে মোটামুটি সত্তর পার করা মা'য়েরা কেমন আছেন ?
![]() |
পৃথিবীর সবচেয়ে নিশ্চিন্ত নিরাপদ দু'টি হাত |
এই শ্রেণীর পরিবারের মা'য়েরা সাধারণতঃ একসঙ্গেই থাকেন। কাদের সঙ্গে? হ্যাঁ, ছেলে-বৌয়ে'র সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে বিবাহিত ছেলে-বৌ নয়, ছেলের সংসারে মা। সংসারের চাবি তো হস্তান্তরিত ! অবশ্য যদি না ছেলে-বৌ ইতিমধ্যেই চাকরি-সূত্রে প্রবাসী হয়ে গিয়ে থাকে, তবেই। বাইরের কোন শহরে ঝাঁ-চকচকে এপার্টমেন্টে দুটো তো মাত্র ঘর। সেখানে মা কোথায় আর বাকিরাই বা কোথায়? একজন বয়স্ক মানুষ কেমন করে থাকবেন ? তাঁর তো একটু স্বাচ্ছন্দ্য দরকার ! আসলে ছেলের কাছে মায়ের থেকে বৌকে স্বাচ্ছন্দে রাখাটা বেশি জরুরি।
তাই পুরোনো ভিটে-বাড়িতে মা একা - সহযোগী একজন সারাদিনের কাজের লোক রইল। ভিটেও বেহাত হলো না, আর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে জগৎজননী তো রইলেনই।
'আচ্ছা মা, তোমার জন্যে তো সারাদিনের কাজের লোক রেখে দিয়েছি ? তোমার যা যা প্রয়োজন তা তো আমাজন কিংবা ফ্লিপকার্টে ৪৮ ঘন্টায় পৌঁছে যাচ্ছে। এর পরেও তোমার আর কি বলার থাকতে পারে বলো তো ! প্রতিটা দিন আমার এই চাই, ওই চাই ! এতো বয়স হল, এই বয়সে এতো কিছুর প্রয়োজন থাকে কি করে' ?
রাতের নিয়মিত ফোনে ছেলে-বৌ'এর ওই একই কথা, 'মা, সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর না ! তোমার রোজ এই এতো ঝামেলার কথা শুনতে ভাল লাগে না । কাজের মাসি কত ভালো, তাকে একটু মানিয়ে নিতে পারছো না? অভিযোগ ছাড়া তোমার কি আর কিছুই জানাবার নেই' ?
বলবার তো অনেক কিছুই আছে রে ! শোনবার লোকেরই তো অভাব ! 'কাজের মাসি' কেমন করে মায়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় ? - মা নিস্তব্ধে ভাবে। টিভির দিকে নিষ্প্রাণ 'চোখ' তাকিয়ে থাকে, শব্দ কানে আসে না।
কোথাও কোথাও আবার অন্য জ্বালা, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য ঠিক ততটা প্রবল নয় যে মাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে 'বৃদ্ধাশ্রমে' প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। আর ঠিক এইরকম প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে মা যদি হারিয়ে থাকেন তাঁর স্বামীকে, তাহলে তো কথাই নেই। তাঁর যে কোন অভিলাষই অসময়ের বাৎসল্য প্রভাব। বন্ধুকে জানাতেই হয়, ' কি করি বল তো? মা না, কেমন যেন দিনকে দিন ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে'।
মা কি কিছুই বোঝে না ? তিনি সব বুঝতে পারেন - এও বোঝেন, স্বামীহারা তিনি বাড়ির 'বোঝা' বৈ আর কিছু নন। তাঁর দেবার দিন তো শেষ। ছেলেবেলায় ছেলের কোন ডাকেই মা সাড়া না দিয়ে পারেন নি, কোনদিন তার কথা শুনতে না পারবার মতো ব্যস্তও থাকতে পারেন নি। আজ ছেলে সারাদিন কাজ নিয়ে অতি ব্যস্ত, কখনও ব্যতিব্যস্ত - মায়ের কাছে দু'দণ্ড বসে তাঁর মনের কথা শোনার সময় কই ? তাই নিজের ব্যস্ততা ও অফিস-সংক্রান্ত ঝামেলা-জঞ্ঝাটের কথা মা'র কান পর্যন্ত কোনভাবে পৌঁছে দিলেই হল - মা চুপ। সব অভিমান গলে জল ; তিনি একমনে প্রার্থনা করবেন ঈশ্বরের কাছে - 'খোকা যেন কোন বিপদে না পড়ে'।
মায়ের যে আজ আর বেশি কিছু চাইবার নেই - তাঁর চাহিদা পাশে শুধুমাত্র একটু কথা বলবার মত কেউ, যার সঙ্গে অন্ততঃ ভাব-বিনিময় করা যাবে, ঘোচানো যাবে চরম একাকীত্ব।
আমাদের অনেকের সংসারেই এই চিত্র খুবই পরিচিত। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে সব মায়েদের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে। তবে এক প্রজন্মের আরো 'বড়ো' হবার অভিপ্রায়ে তার আগের প্রজন্ম অতিরিক্ত 'বুড়ো' হয়ে পড়ছেন না কি ?
আমরা কি পারি না ? নিজের নিজের অঞ্চলে বয়স্ক-বয়স্কাদের জন্যে একটু আনন্দের পসরা সাজিয়ে দিতে ? এমন অভাগী মায়েদের এক ছাদের নিচে 'এক' করে দিতে ? থাক না তাদের ছেলে-মেয়েরা বাইরে ! থাকুক না সংযুক্ত বা যৌথ পরিবারের চিরাচরিত মানসিক বৈপরীত্য, একই ছাদের নিচে সকলে থেকেও !
যদি পাড়ায় পাড়ায় সরকারি-বেসরকারি তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে এমন কোন 'সবুজ আবাস' ? যাতে বয়স্কা মায়েদের ধূসর দৃষ্টিতে সবুজের রঙ লাগে ! মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যেন তাঁরা বাঁচবার আনন্দে বেঁচে থাকেন ? সিনিয়র সিটিজেনদেরও যদি একটা ফোরাম হয় ? এই 'আনন্দ-আশ্রম'-এর সবুজ আবাসন তো নিশ্চই ঘোচাতে পারে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মায়েদের একাকীত্বের অবসাদ। ফিরিয়ে দিতে পারে তাদের নিজস্বতা, আত্ম-বিশ্বাস। সে হাতেই তো তৈরী হয়েছে আজকের প্রজন্ম ! তাঁদের কি আর তখন মৃত্যুর ঠিকানা জানবার প্রয়োজন পড়বে ?
আমার বিশ্বাস, পথিকৃৎ হয়ে এমন পরিবেশ আমরা যদি গড়ে তুলতে পারি, কোন এক প্রজন্ম আবার নতুন করে ঠিক ভাববে যে তাদের একাকী মায়েরা যেন মানসিকভাবে 'বুড়ো' না হয়। মায়েরা যেন তাঁদের সেই সন্তানের হাত ধরে আরও আরও 'বড়ো' হয় সকলের চোখে, যে সন্তানেরা বেড়ে উঠছে আজকের পৃথিবীতে - তাদের সময়ের হাত ধরে, এই 'সময়ে'র বেড়ে ওঠার সাথে সাথে।
একটু ভেবে দেখবেন !!!
©tapanbasu. all rights reserved
photo courtesy /pinterest.ru / lakshyaforias
স্কুলে পড়তাম তখন। আমার পাশে বসা বন্ধুটি হঠাৎ একদিন বলল যে সে নাকি গোয়েন্দা গল্প লিখেছে এবং তার মনে হয়েছে গল্পটা খুব ইন্টারেস্টিং দাঁড়িয়েছে। আমাদের শোনাবে তো বটেই, উপরন্তু সে আমাদের বাংলার স্যারকেও শোনাতে চায়, কিন্তু কিভাবে কথাটা পাড়বে বা ক্লাসে আদৌ উনি শুনতে রাজি হবেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না। আমি বললাম, 'আগে তো আমাদের শোনা ? তারপর আমরা প্ল্যান করব কিভাবে স্যারকে বলব'। গল্পটা ঠিক সাড়ে তিন পাতায় শেষ হয়েছে এবং দেড় পাতার মুখেই আততায়ী ধরা পড়েছে, বাকিটা গোয়েন্দার সমাধান ও অঙ্কের ছক। আমার ওই বন্ধু অঙ্কে অত্যন্ত ভালো ছিল। সকলেই বুঝলাম ওই দুর্বলতা ধরা পড়েছে গল্পের মধ্যে। আমরা বাকি বন্ধুরা এর ওর মুখের দিকে চাইলাম - ঠিক মনে করতে পারলাম না এতো ছোট কোন গোয়েন্দা গল্প তখনও পর্যন্ত আমরা পড়েছি কিনা বা এত দ্রুত কোনদিন কোন অপরাধী ধরা পড়েছে কিনা। বন্ধু কিন্তু তার আবিষ্কৃত গোয়েন্দার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ReplyDeleteআসলে ছেলেবেলায় আমাদের প্রত্যেকেরই একটা হিরো হবার স্বপ্ন থাকতো - মনে মনে। রবিঠাকুরেরও ছিল - তাই হয়ত 'বীরপুরুষ'। কখনও নিজেদের দেখতাম দস্যু মোহন হিসেবে, যে বড়লোকের টাকা হাতিয়ে গরিবদের সাহায্য করত। কখনো বেতাল বা অরণ্যদেব - যে অন্যায়-অবিচারের মুহূর্তে কোথা থেকে এসে আবির্ভূত হত আর একাহাতে দুষ্টের দমন করে ঘোড়ায় চড়ে উধাও হত। খুব ভাবতাম, আমার যদি অমন একটা ঘোড়া আর পোষা কুকুর থাকত ! তাহলে আমিও এমন সমাজসংস্কারে মেতে থাকতাম আর হিরো হয়ে জীবন কাটাতাম আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে। গোয়েন্দা হয়ে চোর ধরবার যে অভিপ্রায় একেবারে ছিল না, তা হলফ করে বলতে পারি না। আমাদের এক বন্ধু ভারত সরকারের তেমন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরিও করে।
আচ্ছা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ? আপনাদের মধ্যে আজকেও কেউ কি এমন স্বপ্ন সে দেখেন না ? 'যে আপনি' মানুষের বিপদের মূহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কি পুলিশ, কি প্রশাসন - কেউই আপনার মুখের ওপর কথা বলছে না - আপনিই সেখানে শেষ কথা। প্রতিটি বিপদগ্রস্ত মানুষ অন্ততঃ প্রকৃত অর্থে উদ্ধার পাচ্ছে তার প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে - সেখানে নেই কোন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ। কিন্তু না, আমরা ইচ্ছে থাকলেও সেটা করতে পারি না। কারণ প্রত্যেক দেশে তাদের নিজস্ব নিয়ম-নীতি আছে, আচার আছে এবং সেটা দেখবার যথাযথ লোকজন আছে। এই মানসিক দোলাচলে আমার মনে হল, ইচ্ছেগুলো জড়ো করি না ! তুলে ধরি না নিজের কলমে ! আমার ইচ্ছেগুলোতে হয়তো একদিন দেখব অনেক মানুষ সহমত হয়েছেন - সেদিন অন্ততঃ একটা ভালোলাগা আমাদের সকলের মধ্যে কাজ করবে যে আমরা একজোট হলে একটা বড় ভালো কাজ করতেও পারি, যেটা আজ হয়ত একা করে উঠতে পারছি না। তাই আজ থেকে যখন যেরকম মনে হবে, মাঝে-মধ্যে লিখব "একটু ভেবে দেখুন"। উল্টো-পাল্টা ভাবনাও সেখানে থাকতে পারে। 'ভাবুন' বললাম আর সবাইকে তা নিয়ে ভাবতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয় নি। আমিও যে প্রভূত ভাবনা দিয়ে কিছু ভরিয়ে তুলতে পারব তেমন আশাও দেখছি না - তবুও .......... একটু ভেবে দেখুন।
আমার অন্যতম সংগীত-গুরু শ্রী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখা গানের একটি লাইন উদ্ধৃত করে আজকের "একটু ভেবে দেখুন" আপনাদের কাছে তুলে ধরব। ভুল-ত্রূটি নিজগুণে মার্জনীয়।
"ছড়িয়ে রয়েছ কেন ?
একবার হলে জড়ো -
আলোর প্রতিযোগিতায়
তোমরা সূর্যের চেয়ে বড়ো ।
ছড়িয়ে রয়েছ কেন ?"
রইল আজকের "একটু ভেবে দেখুন" - বিষয় : 'মা'