বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১২) | Baro Bismay Jage Ep#12
বড়ো বিস্ময় জাগে
পর্ব-১২
ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসের পাতায় এবার একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। তৎকালীন গোঁড়া সংস্কার-আচ্ছন্ন সমাজের পটভূমিকায় খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু এই ভূমিকা। আমি চেষ্টা করছি খুব প্রাঞ্জলভাবে ছোট্ট করে সেই গোড়ার কথা শোনাতে।
পর্ব-১২
ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসের পাতায় এবার একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। তৎকালীন গোঁড়া সংস্কার-আচ্ছন্ন সমাজের পটভূমিকায় খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু এই ভূমিকা। আমি চেষ্টা করছি খুব প্রাঞ্জলভাবে ছোট্ট করে সেই গোড়ার কথা শোনাতে।
কোথাও কোন এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন - 'আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে, যেমন সন্ধেবেলায় দীপ জ্বালবার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো'।
কান্যকুব্জ থেকে আগত পঞ্চসাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের অন্যতম ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন, রাজা ক্ষিতিসুরের কাছ থেকে বর্ধমানের কুশ গ্রাম প্রাপ্ত হয়ে, 'কুশারী' পদবীতে পরিচিত হন। দীন কুশারীর ৮/১০ পুরুষ পরের একজন জগন্নাথ কুশারী, যিনি পিরালী ব্রাহ্মণ শুকদেব রায়চৌধুরীর এক কন্যাকে বিবাহ করে খুলনা গ্রামে ভূসম্পত্তি পেয়ে সেখানেই বাস করতে শুরু করেন। এরও পাঁচ-ছয় পুরুষ পর পঞ্চানন কুশারী খুলনা গ্রাম বা দক্ষিণডিহি ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। ঘর বাঁধলেন গোবিন্দপুর গ্রামে, সেখানে হরিজনদের বাস। ব্রাহ্মণ পঞ্চাননকে তারা ভক্তিভরে 'ঠাকুরমশাই' বলে ডাকত - ব্রাহ্মণকে তো আর নাম ধরে ডাকা যায় না, তাই। পঞ্চানন ইংরেজ জাহাজওয়ালাদের মালপত্র সরবরাহ করতেন। সাহেবরাও পঞ্চাননদের 'ঠাকুর' বলে ডাকতে শুরু করল এবং তাদের মুখে ঠাকুর শব্দটা ক্রমশঃ বিকৃত হয়ে হল Tagore।
এইভাবে কুশারী পদবি গেল উঠে - তারাই ঠাকুর পদবি'র ব্যবহার শুরু করে দিলেন। সেই থেকে কুশারী পদবীর পরিবর্তে ঠাকুর বা টেগোর নাম প্রচলিত হয়। এই পঞ্চাননের পুত্র জয়রাম ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে কাজ করবার সুবাদে বেশ দু-পয়সা করেন। জয়রামের পুত্র নীলমণি হলেন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ। নীলমণি ও তার ভাই দর্পনারায়ণ - এই দুই ভাইয়ের টাকায় পাথুরিয়াঘাটায় জমি কিনে ঘর-বাড়ি ইত্যাদি তৈরী হল।
কিন্তু অর্থই অনর্থের মূল - এ তো ঋষিবাক্য। মন কষাকষির কারণে নীলমণি পাথুরিয়াঘাটা থেকে বেরিয়ে গেলেন ভাইয়ের কাছে নগদ অর্থ বুঝে নিয়ে। কলকাতার চিৎপুর রাস্তার পুবদিকে জমি কিনে ঘর তৈরী করলেন নীলমণি। তখন ১৭৮৪ সাল - ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকাল। ওপাড়ার তখনকার নাম ছিল মেছোবাজার, যা পরে জোড়াসাঁকো নাম হয়।
এই পরিবারে জন্ম নিলেন দ্বারকানাথ - ১৭৯৪ তে। সে যুগের নামকরা ব্যবসায়ী, বিদ্বান, মানী, গুণী ও ধনবান - কি বাঙালি, কি ইংরেজ বণিকসমাজ বা রাজপুরুষ - সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে ধন এল, মান এল, প্রতিপত্তি বাড়তে লাগল। যেমন রোজগার করতেন দ্বারকানাথ, তেমনই পয়সা ওড়াতেন। তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে এলাহী নাচ-গান-খানাপিনার আসরে আমন্ত্রণ পাবার জন্যে উন্মুখ থাকতেন মেমসাহেবরাও। এর সঙ্গে ছিল বিস্তর দান-ধ্যান - অকাতরেই দান করতেন তিনি। এহেন উদারচেতা মনোভাব-আচরণ-বৈভব-বিলাসে দ্বারকানাথ হয়ে উঠলেন 'প্রিন্স দ্বারকানাথ'। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ এই দ্বারকানাথেরই পুত্র। ১৮১৭তে তাঁর জন্ম। মাত্র ১২ বছর বয়সে দেবেন্দ্রনাথের বিবাহ হল ৬ বছরের সারদাদেবীর সঙ্গে (১৮২৯)। ১৮৬১র ৭ই মে মহর্ষিভবনে শেষরাত্রে ভূমিষ্ঠ হলেন রবীন্দ্রনাথ। ওই বছরেই বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত অমিত্রাক্ষর ছন্দে 'মেঘনাদবধ' কাব্য রচিত হয়। ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির অঙ্গনে এ যেন জোড়া ফলা।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যৌবনকালে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার পর থেকেই (১৮৪৩) ঠাকুর পরিবারে যুগান্তর এসেছিল।বহু চিরাচরিত সংস্কার ও ধ্যানধারণা, যেমন হিন্দু পরিবারের বারো মাসে তেরো পার্বণ, পূজা-উৎসব ইত্যাদি দেবেন্দ্রনাথ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের পিতা দ্বারকানাথ ছিলেন যেমন ধনী ও মানী, তেমনি শৌখিন ও বিলাসী। হিন্দু-সংস্কার, আধা-মোগলাই সমস্ত আদব-কায়দা থেকে বেরিয়ে ঠাকুরবাড়িতে আবির্ভূত হল বিলাতি ছবি, ইতালিয় পাথরের মূর্তি, বিলাতি আসবাব ইত্যাদি।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর - ভারতের সর্বপ্রথম আই সি এস - বিলেত থেকে ফিরে আসার পর তাঁর বিলাতি-কেতায় ঘর ও বাইরের দূরত্ব কমতে থাকল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন - এও সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবের প্রত্যক্ষ ফল। রবীন্দ্রনাথের কৈশোর ও যৌবনের অনেক দিন কেটেছে সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিদাদার সঙ্গে নতুন আবহাওয়ায়, নতুন পরিবেশে। আমার মনে হয়, রবিঠাকুরের প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলবার অভিনব প্রয়াস হয়ত সেই সময় থেকেই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে থাকবে। নইলে 'তাসের দেশ' প্রহসন-নাটকে 'আমরা নূতন যৌবনেরই দূত' গানে বেড়া ভাঙার কাহিনি যখন শোনাচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স ৭২ বছর।
আজ এই পর্যন্তই। পরের পর্বে গোবিন্দপুর থেকে কলকাতা - ভুবনডাঙ্গা থেকে শান্তিনিকেতন।
১৮৬০ - কলকাতার গ্রাম |
এইভাবে কুশারী পদবি গেল উঠে - তারাই ঠাকুর পদবি'র ব্যবহার শুরু করে দিলেন। সেই থেকে কুশারী পদবীর পরিবর্তে ঠাকুর বা টেগোর নাম প্রচলিত হয়। এই পঞ্চাননের পুত্র জয়রাম ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে কাজ করবার সুবাদে বেশ দু-পয়সা করেন। জয়রামের পুত্র নীলমণি হলেন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ। নীলমণি ও তার ভাই দর্পনারায়ণ - এই দুই ভাইয়ের টাকায় পাথুরিয়াঘাটায় জমি কিনে ঘর-বাড়ি ইত্যাদি তৈরী হল।
পাথুরিয়াঘাটা রাজপ্রাসাদ ঠাকুরপরিবারের মহারাজা বাহাদুর স্যার যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের |
ব্রিটিশ উপনিবেশের শুরু |
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যৌবনকালে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার পর থেকেই (১৮৪৩) ঠাকুর পরিবারে যুগান্তর এসেছিল।বহু চিরাচরিত সংস্কার ও ধ্যানধারণা, যেমন হিন্দু পরিবারের বারো মাসে তেরো পার্বণ, পূজা-উৎসব ইত্যাদি দেবেন্দ্রনাথ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের পিতা দ্বারকানাথ ছিলেন যেমন ধনী ও মানী, তেমনি শৌখিন ও বিলাসী। হিন্দু-সংস্কার, আধা-মোগলাই সমস্ত আদব-কায়দা থেকে বেরিয়ে ঠাকুরবাড়িতে আবির্ভূত হল বিলাতি ছবি, ইতালিয় পাথরের মূর্তি, বিলাতি আসবাব ইত্যাদি।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর - ভারতের সর্বপ্রথম আই সি এস - বিলেত থেকে ফিরে আসার পর তাঁর বিলাতি-কেতায় ঘর ও বাইরের দূরত্ব কমতে থাকল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন - এও সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবের প্রত্যক্ষ ফল। রবীন্দ্রনাথের কৈশোর ও যৌবনের অনেক দিন কেটেছে সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিদাদার সঙ্গে নতুন আবহাওয়ায়, নতুন পরিবেশে। আমার মনে হয়, রবিঠাকুরের প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলবার অভিনব প্রয়াস হয়ত সেই সময় থেকেই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে থাকবে। নইলে 'তাসের দেশ' প্রহসন-নাটকে 'আমরা নূতন যৌবনেরই দূত' গানে বেড়া ভাঙার কাহিনি যখন শোনাচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স ৭২ বছর।
আজ এই পর্যন্তই। পরের পর্বে গোবিন্দপুর থেকে কলকাতা - ভুবনডাঙ্গা থেকে শান্তিনিকেতন।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১২/চলবে ..........
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy > (1)ebay (2)johnston & hoffmann/waqar A khan (3)quora
©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy > (1)ebay (2)johnston & hoffmann/waqar A khan (3)quora
Comments
Post a Comment