বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১১) | Baro Bismay Jage Ep#11

বড়ো বিস্ময় জাগে 
পর্ব-১১
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি

জোড়াসাঁকো এবং শান্তিনিকেতন - এই দুইয়ের গোড়ার কথা একটু বলে দিলে বুঝতে সুবিধে হয় যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের আমলে পারিবারিক উত্তরণের ইতিহাস কেমন করে এতটা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ওপর এবং মহর্ষির জীবনচর্চায়ই বা কিভাবে ছোটবয়সেই রবীন্দ্রনাথকে শিখিয়েছিল সত্য ও সুন্দরকে অনুভবে ছুঁয়ে যেতে !

সেই আবহমান ধারা যে আজ আমাদেরকেও স্পর্শ করে !

আমাদের রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে শেখা একটি নিত্য-অভ্যাসের কথা বলি। পর্ব ৮-এ আমি বলেছি বালক রবির অমৃতসরের গুরুদ্বারে শিখ ভজন শুনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি হিন্দি গানের বাংলা তর্জমা করবার ঘটনা।  মাথায় রাখতে হবে, এ সবই ১১, ১২ কিংবা ১৩ বছর বয়সের অভিজ্ঞান। ওই সময়ই জ্যোতিদাদার 'সরোজিনী' নাটকে রাজপুত মহিলাদের চিতায় আত্মাহূতির মুহূর্তে 'জ্বল জ্বল চিতা' গানের প্রয়োগ কতটা বিস্ময়কর, তা সহজেই অনুমেয় এবং এহেন প্রতিভার স্বাক্ষর আজকের দিনেও বিরল। যেটা যোগ করতে ভুলে গেছিলাম, 'সরোজিনী' নাটকে নাম-ভূমিকায় অভিনয় করতেন নটি বিনোদিনী - যে নটি বিনোদিনীর বাংলা থিয়েটার-এ অভিনয় জীবন ছিল মাত্র ১২ বছরের এবং সেটি শুরু হয়েছিল ১৮৭৪এ শ্রী গিরিশ ঘোষের তত্ত্বাবধানে।   

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি - অলিন্দ থেকে
আমার খেদ হয়, আজকালকার শিশুদের কাছে বোকাবাক্সে মুখ দেখিয়ে গান শোনানোর বাইরে প্রতিভা প্রকাশের ও বিকাশের আদর্শ মঞ্চ বড়োই দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। আর সেও তো শুধুমাত্র কণ্ঠশিল্পীদের জন্যেই নির্দিষ্ট প্রতিযোগিতামূলক আসর - শিল্পকলার বাকি আঙ্গিকগুলো কেবলমাত্র সহযোগী। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের বর্তমান অদর্শন-অনুপস্থিতিতে শিশুদের পাশে যেমন কোন প্রতিভাবান নিকট-আত্মীয়কে পাবার সুযোগই নেই - তেমনই অমিল প্রতিদিনের পারিবারিক জীবনচর্চার সান্নিধ্য, যেখানে উৎস হতে উৎসারিত হবার রসদটুকু শিশু আপনা হতে কুড়িয়ে নিতে পারে। ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচে বাপ্-ঠাকুরদা-ভাই-বোন, প্রত্যেকের রক্তে যে অফুরান সৃষ্টিসুলভ সংস্কৃতি-চেতনার উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, সেখানে শিশু অবস্থায় বা বালক-কিশোর-যুবা বয়সে অযাচিতচাবে সেই চেতনার বিকাশ আপনা হতেই প্রস্ফুটিত হবার সুযোগ পেত। 

যাক সে সেসব কথা - কবির ছেলেবেলার নিত্য-অভ্যাসের যে গল্প বলছিলাম -
১৮৭৩-৭৪ এর চৈত্র মাসের শেষের দিকে অমৃতসর-পাঠানকোট হয়ে কবি ডালহৌসি পাহাড়ে অবস্থিত বক্রোটা শৈলশহরে এসে পৌঁছলেন। মহর্ষির লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ওই সময় বালক রবি পিতার কাছে সংস্কৃত ও ইংরেজী শিক্ষার পাঠ নিতেন, সঙ্গে চলত ব্রাহ্মধর্মশিক্ষা। বক্রোটার বাসায় রবিঠাকুরের শোবার ঘর ছিল কোণার দিকে, একটি প্রান্তে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাহাড়চূড়ায় মাখামাখি করা বরফের উপর আলোর খেলা দেখতেন। এক একদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে চোখে পড়ত, পিতা মহর্ষি একটি লাল রঙের শালে সর্বাঙ্গ ঢেকে উপাসনায় চলেছেন। রাত্রির অন্ধকার থাকতেই বালক রবিকে ডেকে তুলতেন - কারণ সেইটিই ছিল উপক্রমণিকার শব্দ মুখস্থের আদর্শ সময়। 

আমার বিস্ময় কেন লাগে জানেন ? কবি আমরণ মহর্ষির দেখানো ঐ ভোর-রাত্রে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসের অন্যথা করেন নি। এটি না মানলে মহাভারত অশুদ্ধ হত না । নিয়ম-শৃঙ্খলা আসলে আমাদের মনস্তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা - এটি পাঁচন করে গিলিয়ে দেওয়া যায় না। 

আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করছি - কারণ তিনি আলোকবর্তিকা - সুদূর পথের দিশারী। আসলে তাঁকে ঘিরে যে কোন আয়োজনই সীমিত শব্দে বন্দী করা আমার মত তাঁর পায়ে আশৈশব মাথা নত করা অপটু লেখকের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই  আজ এই পর্যন্তই। 

ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস খুব অল্প হলেও ছুঁয়ে যাব - আগামী পর্বে। 

'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১১/চলবে ..........


'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (১২) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >trip / so city 

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু