সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-২২) | Sagarparer Diary (Episode-22)
সাগরপারের ডায়েরি
পর্ব-২২
আজকের প্রসঙ্গ : মূল অনুষ্ঠানের ইতিবৃত্ত
'যাত্রী আমি'র ১ম পর্ব শেষ করলাম কবিকণ্ঠে 'তবু মনে রেখো দিয়ে'। কবির স্বকণ্ঠের সেই গানের রেশের সঙ্গে খুব হালকা করে মোহরদির গাওয়া সর্বজনবন্দিত 'তবু মনে রেখো' এসে মিশে গেল - ঠিক যেমন করে স্রোতস্বিনীর ভিন্ন ভিন্ন ধারা এসে মেশে নদীর মোহনায়, সমুদ্রের অববাহিকায়। মঞ্চের আবহ অনুজ্জ্বল হতে থাকল - শুরু হলো সমবেত গান 'ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক'।
কবিগুরুর সংগীত-চেতনা নিয়ে আমরা প্রায়শই চর্চা করি। বিশ্বজোড়া খ্যাতনামা সংগীতকার - রবার্ট বার্ন্স্, শুবার্ট, হ্যুগো উলফ - এঁদের নাম আমরা জানি - এঁরা বহু বিশ্বখ্যাত গানের রচয়িতা। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, বিশ্বজুড়ে রবার্ট বার্ন্সকে নিয়ে যে Celebration চলে, তার আপেক্ষিক মূল্য বা যাকে আমরা সহায়ক বাণিজ্য বলি, স্কটল্যান্ড সরকারি হিসেবে তা প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড প্রতি বছরে। অর্থাৎ, শুধু বার্ন্সকে নিয়ে প্রচার, তাঁর জন্যে মিউজিয়াম ইত্যাদি পরোক্ষভাবে সে দেশের সরকারকে এই প্রভূত অর্থ-বাণিজ্যে আয় করতে সহায়তা করে। রবার্ট বার্নসের বিখ্যাত গান "auld lang syne" থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন "পুরানো সেই দিনের কথা"।
আমি পাশ্চাত্য তথ্যের অনেক কিছুর মধ্যে মাত্র একটা উদাহরণ দিলাম। যেটা বলবার, তা হলো, এতকিছু সত্ত্বেও, এঁদের গানের পাশাপাশি আমরা যদি রবিঠাকুরের গান শুনি, তখন বুঝতে পারি তাঁর সংগীত-চেতনা কত গভীর। তাঁর মনের অনুচ্চারিত ইতিহাস, যা হয়তো তিনি গল্পে-উপন্যাসে-কবিতায় প্রকাশ করে উঠতে পারেন নি, তা অনুভব হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর ছবি ও গানে। তেমন এক মগ্ন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শ্রীমতি কৃষ্ণা দত্ত (লন্ডন) এই বিষয়টির উপর পর্যালোচনা করলেন অনুষ্ঠানের ২য় পর্বে। প্রকাশিত হল তাঁর লেখা বই 'Why Rabindranath' |
সেই বই-প্রকাশ অনুষ্ঠানে শ্রী অনিরুদ্ধ সান্যাল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) আলোকপাত করলেন তাঁর নিজের লেখা একটি প্রবন্ধের উপর। নাম 'Disconnected Genius' - Prince Dwarakanath & Babu Rabindranath | আবিরের সুনিপুণ এস্রাজ বাদন আর তার সঙ্গে মার্জিত আবহে আবৃত্তি "আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো" দিয়ে সমাপ্ত হল ২য় পর্ব।
১২ বছরের ব্যবধানে দুটি গান রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ২টি গানই 'শ্র্রী' রাগে আশ্রিত - তাদের মূল সূত্র আলাদা। সেগুলিকে আমরা ভাঙা গান হিসেবে পাই। গান দুটি হলো - 'আইল শান্ত সন্ধ্যা' ও কার মিলন চাও বিরহী'। ভাবের গভীরতায় গান দুটি টেনে নিয়ে যায় ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে, বন্ধন থেকে মুক্তিতে - সেটাই বৈকুন্ঠ।
অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্ব শুরু করলাম এইভাবে - 'শ্রী' রাগে আবির অল্প আলাপপর্ব ও আওচার করবার পর মোহনদা দরাজ কণ্ঠে প্রথমে 'আইল শান্ত সন্ধ্যা' দিয়ে শুরু করে 'কার মিলন চাও বিরহী'তে পৌঁছে শ্রোতাদের একেবারে মোহাবিষ্ট করে তুললেন। রবীন্দ্রসংগীতের অনুষঙ্গে বিপ্লবদার বাজনা বরাবরই অত্যন্ত উচ্চমানের - পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গে তো সেটা অননুকরণীয়। 'শ্রী'-আশ্রিত গানে বিপ্লবদার বড়ো মুখের তবলায় প্রতিটি স্ট্রোক বা বোল-বাণী যেন পাহাড়ি নদীর ছোট-বড় পাথর ডিঙিয়ে ঝিরিঝিরি বয়ে চলার সঙ্গেই একমাত্র তুলনীয়।
একটি ছবি মনের কল্পনায় ভেসে ওঠে ...... সুরের মায়াজাল বিস্তার করছে শ্রোতাদের প্রত্যেকটি তন্ত্রীতে - তাঁরা নেশাগ্রস্তের মতো ক্রমশঃ আচ্ছন্ন হচ্ছেন - বিবশ শিথিল হচ্ছে তাঁদের স্নায়ু। এমন অভাবনীয় সাঙ্গীতিক পরিবেশের মধ্যে আমি উপলব্ধি করলাম - এর দৃশ্যায়ন তুলির টানে একমাত্র কোনো মহান চিত্রশিল্পীর পক্ষেই হয়তো বা উপস্থাপনা করা সম্ভব - আমার পক্ষে কলমের আঁচড়ে তা বর্ণনা করা প্রায় দুঃসাধ্য।
আমার পাঠকদেরও আজকের মতো ছুটি দিলাম। এবার বাড়ি ফেরার গল্প - পরের পর্বে।
'সাগরপারের ডায়েরি'র অন্তিম (২৩তম) পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
Picture Courtesy >(1)HistoryExtra (2)luisdias.wordpress(3)GandhiInformationsZentrum
'যাত্রী আমি'র ১ম পর্ব শেষ করলাম কবিকণ্ঠে 'তবু মনে রেখো দিয়ে'। কবির স্বকণ্ঠের সেই গানের রেশের সঙ্গে খুব হালকা করে মোহরদির গাওয়া সর্বজনবন্দিত 'তবু মনে রেখো' এসে মিশে গেল - ঠিক যেমন করে স্রোতস্বিনীর ভিন্ন ভিন্ন ধারা এসে মেশে নদীর মোহনায়, সমুদ্রের অববাহিকায়। মঞ্চের আবহ অনুজ্জ্বল হতে থাকল - শুরু হলো সমবেত গান 'ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক'।
![]() |
রবার্ট বার্ন্স্, স্কটিশ কবি |
আমি পাশ্চাত্য তথ্যের অনেক কিছুর মধ্যে মাত্র একটা উদাহরণ দিলাম। যেটা বলবার, তা হলো, এতকিছু সত্ত্বেও, এঁদের গানের পাশাপাশি আমরা যদি রবিঠাকুরের গান শুনি, তখন বুঝতে পারি তাঁর সংগীত-চেতনা কত গভীর। তাঁর মনের অনুচ্চারিত ইতিহাস, যা হয়তো তিনি গল্পে-উপন্যাসে-কবিতায় প্রকাশ করে উঠতে পারেন নি, তা অনুভব হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর ছবি ও গানে। তেমন এক মগ্ন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শ্রীমতি কৃষ্ণা দত্ত (লন্ডন) এই বিষয়টির উপর পর্যালোচনা করলেন অনুষ্ঠানের ২য় পর্বে। প্রকাশিত হল তাঁর লেখা বই 'Why Rabindranath' |
সেই বই-প্রকাশ অনুষ্ঠানে শ্রী অনিরুদ্ধ সান্যাল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) আলোকপাত করলেন তাঁর নিজের লেখা একটি প্রবন্ধের উপর। নাম 'Disconnected Genius' - Prince Dwarakanath & Babu Rabindranath | আবিরের সুনিপুণ এস্রাজ বাদন আর তার সঙ্গে মার্জিত আবহে আবৃত্তি "আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো" দিয়ে সমাপ্ত হল ২য় পর্ব।
![]() |
শান্তিনিকেতনে শিক্ষার আলো - প্রসারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ |
১২ বছরের ব্যবধানে দুটি গান রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ২টি গানই 'শ্র্রী' রাগে আশ্রিত - তাদের মূল সূত্র আলাদা। সেগুলিকে আমরা ভাঙা গান হিসেবে পাই। গান দুটি হলো - 'আইল শান্ত সন্ধ্যা' ও কার মিলন চাও বিরহী'। ভাবের গভীরতায় গান দুটি টেনে নিয়ে যায় ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে, বন্ধন থেকে মুক্তিতে - সেটাই বৈকুন্ঠ।
অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্ব শুরু করলাম এইভাবে - 'শ্রী' রাগে আবির অল্প আলাপপর্ব ও আওচার করবার পর মোহনদা দরাজ কণ্ঠে প্রথমে 'আইল শান্ত সন্ধ্যা' দিয়ে শুরু করে 'কার মিলন চাও বিরহী'তে পৌঁছে শ্রোতাদের একেবারে মোহাবিষ্ট করে তুললেন। রবীন্দ্রসংগীতের অনুষঙ্গে বিপ্লবদার বাজনা বরাবরই অত্যন্ত উচ্চমানের - পাখোয়াজ বা মৃদঙ্গে তো সেটা অননুকরণীয়। 'শ্রী'-আশ্রিত গানে বিপ্লবদার বড়ো মুখের তবলায় প্রতিটি স্ট্রোক বা বোল-বাণী যেন পাহাড়ি নদীর ছোট-বড় পাথর ডিঙিয়ে ঝিরিঝিরি বয়ে চলার সঙ্গেই একমাত্র তুলনীয়।
একটি ছবি মনের কল্পনায় ভেসে ওঠে ...... সুরের মায়াজাল বিস্তার করছে শ্রোতাদের প্রত্যেকটি তন্ত্রীতে - তাঁরা নেশাগ্রস্তের মতো ক্রমশঃ আচ্ছন্ন হচ্ছেন - বিবশ শিথিল হচ্ছে তাঁদের স্নায়ু। এমন অভাবনীয় সাঙ্গীতিক পরিবেশের মধ্যে আমি উপলব্ধি করলাম - এর দৃশ্যায়ন তুলির টানে একমাত্র কোনো মহান চিত্রশিল্পীর পক্ষেই হয়তো বা উপস্থাপনা করা সম্ভব - আমার পক্ষে কলমের আঁচড়ে তা বর্ণনা করা প্রায় দুঃসাধ্য।
আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে .......কিভাবে যেন কেটে গেল তিন-তিনটি ঘন্টা। আগেই বলেছি, এই প্রেক্ষাগৃহে শিল্পী ও শ্রোতার মধ্যে কোন বিভাজন রেখা নেই। গোলাকৃতি স্টেজে কখন যে আমরা সকলে এক ও একাত্ম হয়ে গিয়েছি, তা নিজেরাই টের পাইনি। নানা ভাষাভাষী, নানা জাতির বর্ণময় উপস্থিতিতে এক মনোরম সন্ধ্যা উপভোগের পর হোটেলে ফিরলাম বেশ রাত করে। ডিনার শেষে আমি, মোহনদা, বিপ্লবদা ও আবির আড্ডা জমালাম হোটেলের বাইরের লবিতে। পরিচ্ছন্ন আকাশে তারাদের রূপকথা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের পরিবেশ মনটাকে কেমন উদাস করে ফেলল। আচ্ছন্ন-ঘোর, জমাটি আড্ডা, দেদার লিমকা ও কোক - মাঝরাত্রে হোটেলের নিজের তৈরী করা কেক ......... আকাশের কালো পর্দা ফাঁক করে আলো উঁকি দিল - খুবই আবছা তার বহিঃপ্রকাশ।
..................কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি -মস্ত একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল হোটেলের মূল ফটকে - দুধের গাড়ি। টুকটুকে ফর্সা মোটাসোটা চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক রকমারি চেহারার দুধের কন্টেইনার নিয়ে হোটেলে ঢুকলেন। ঘড়িতে দেখলাম ভোর ৪টে। সূর্যের দেখা পেতে আরো প্রায় দু'ঘন্টা। একই সাথে Good Night ও Good Morning জানিয়ে যে যার ঘরে শুতে গেলাম।
আমার পাঠকদেরও আজকের মতো ছুটি দিলাম। এবার বাড়ি ফেরার গল্প - পরের পর্বে।
সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-২২/চলবে ..........
'সাগরপারের ডায়েরি'র অন্তিম (২৩তম) পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Comments
Post a Comment