সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-২১) | Sagarparer Diary (Episode-21)

সাগরপারের  ডায়েরি
পর্ব-২১
আজকের প্রসঙ্গ : মূল অনুষ্ঠানের ইতিবৃত্ত 

মূল অনুষ্ঠান বেশ জমে উঠেছে, শ্রোতারাও আপ্লুত সুরের রসে। পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরে যে নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারণ করা উচিত -তা হল দেবব্রত বিশ্বাস। 
একটা অপূর্ব সুরেলা অথচ 'ব্যারিটোন ভয়েস' গেয়ে চলেছে - 'মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই'। আমরা যেন শুনতে পাচ্ছি মেঘের আওয়াজ। যে আওয়াজ 'আট থেকে আশি' - সকলকে বিশ্বাসের সঙ্গে বলছে - "রবীন্দ্রনাথের গান ! এ তো আমার নির্জন একাকীর - আমি গাইতে বড্ডো ভালোবাসি"।
দেবব্রত 'জর্জ' বিশ্বাস
কিন্তু না ! তিনি ভালোবাসলেই তো চলবে না ! গান শুনে ছেলে-বুড়ো মোহিত হলেই বা কি আসে যায় ? রবীন্দ্রসংগীতে এই Emotion, এই Expression - কেউ দিতে পারল না ! আর তিনি এসে একাই সব দিয়ে দিলেই যে খাতায়-কলমে গোঁড়া তদানীন্তন  রবীন্দ্র-রক্ষকদের তা  মেনে নিতে হবে, এমন তো কোথাও লেখা নেই ! সুতরাং শ্রোতৃমহলে জর্জদার অপরিসীম জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও বিদগ্ধজন তাঁকে প্রকাশ্যে গ্রহণ করলেন না। বড়ো অভিমান নিয়ে চলে গেলেন জর্জদা - ১৯৮০ সালে। আশ্চর্য ! সেই শ্রাবণ মাসেই । চলে যাবার আগে আমাদের জন্যে রেখে গেলেন তাঁর মনের কথা - বই আকারে। যে বইয়ের নাম "ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত"। অমন এক উচ্চমানের কণ্ঠশিল্পীর গান যদি গ্রামোফোন কোম্পানির দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছতে না দেওয়া হয়, তা এক অমার্জনীয় অপরাধ। আর সেই কষ্ট বুকের ভেতর সইয়ে নিয়ে একজন শিল্পীর পক্ষে সেই গান নিয়েই বেঁচে থাকা যে কতটা যন্ত্রণার হতে পারে, তা অনুভব করতে চাইলে তাঁর লেখা বইটি পড়ে দেখা যেতে পারে। 
তথ্য ও গান সহযোগে ভারী চমৎকার এগিয়েছিল আমাদের প্রাথমিক পর্বের ভাবনা - ওই মঞ্চে। পিছনের পর্দায় প্রজেক্শনে 'শালবীথির বনে দন্ডায়মান রবীন্দ্রনাথ' কি শুনলেন রেকর্ডে গাওয়া জর্জদার সেই বিখ্যাত গান "আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী"? তিনিও যে জন্ম-বাউল; সুদূরের পিয়াসীও যে - সে বিষয়ে তো কোনই সন্দেহ নেই। আমি লিখে ফেললাম দু'কলম মনের কথা -
আষাঢ়-শ্রাবণ - 
আকাশ ভেঙে দেখি জলের প্লাবন;
'জর্জ'দার সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র
বড় অস্থির তবু কেন যে মন !
সবুজের দু'চোখেও যেন জলের ফোঁটা -
দিগন্তে ঝড় - মাটিতে বৃষ্টি 
লুকোচুরি খেলতেই কি এভাবে ছোটা ?
 এক শ্রাবণের গর্ভ ফুটে দেবব্রতের বিশ্বাস,
 আরেক শ্রাবণ ছায়ায় ঢাকে "মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস"!
 রবির আলো নিভেছিল ওই, শ্রাবণভেজা দিনে -
 সেই শ্রাবণেই বিশ্বাস বিলীন - ছন্দপতনে, 
হয়তো 'ধ্বনিল আহ্বান' নবজন্মে -
অন্তরের সাথে আত্মার মিলনে ।।

সুচিত্রা মিত্র
শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্র - প্রবীণ সুচিত্রাদি - সাদা বয়-কাট চুল, অন্তরস্পর্শী চাহনি, সোজা কথা, দৃপ্ত পদক্ষেপ - নিজস্ব style statement - রবীন্দ্রসংগীত ব্রহ্মান্ডের Icon।  রবিঠাকুরের সাধের 'কৃষ্ণকলি' সুচিত্রার কণ্ঠে কতটা সমাদৃত হলে তবে তা সমসাময়িক বা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁর নামের সাথে সমার্থক হয়ে উঠতে পারে ! 'কৃষ্ণকলি, আমি তারেই বলি' এ রবীন্দ্রগান যেন সুচিত্রা মিত্রের আপনার গান হয়ে উঠেছিল - সে সময়। যেমন কণ্ঠের ওজন, বাণীর ওপর স্বরক্ষেপণের তেমনই অসামান্য প্রয়োগ-বৈচিত্র্য তাঁকে রবীন্দ্র-গায়িকা হিসেবে অনন্যা করে তুলেছিল, তার জাজ্বল্য প্রমাণ অজস্র রেকর্ড ও ডিস্কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। 
আমরা শোনালাম - 'এবার তোর মোর গাঙে বান এসেছে, 'জয় মা' বলে ভাসা তরী'। কোরাস গানের কোলাজে, নৃত্যের আবহে সত্যি সত্যিই এক নতুনের জোয়ারে ভেসে গেলাম উপস্থিত সবাই। 

আচার্য শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও আরো কিছু নাম, যেমন শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাগর সেন, শ্রীমতি গীতা ঘটক, নীলিমা সেন, পূর্বা দাম, রমা মন্ডল প্রমুখ বিরল ব্যক্তিত্বদের ভূমিকা ও তাঁদের অবদানের বিষয়ে সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায় আলোচিত হলো। এঁদের রেকর্ডে ধৃত কণ্ঠের জাদুতে প্রেক্ষাগৃহে ইন্দ্রজাল রচিত হল।  
আসলে  ..........
রবীন্দ্রসংগীতের সীলমোহরের দুই পীঠ - কণিকা ও সুচিত্রা
রবির আলোয় চোখ মেলে যে, তার কোন নেই ক্ষয় -
সৃষ্টি-রূপের অনুষঙ্গে মন নির্ভয়, নিঃসংশয়। 

পিছনের পর্দায় সত্যজিৎ রায়ের ডকুমেন্টারির অংশবিশেষ উঠে এলো বারে বারে - প্রথম পর্বে সেটাই ছিল 'ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি'।

বাকি দুই পর্বের কথা আজ তোলা রইলো 'সাগরপারের ডায়েরি'র পরের পর্বের জন্যে। 


সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-২১/চলবে ..........

'সাগরপারের ডায়েরি'র ২২তম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন'সাগরপারের  ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy >(1)murukkuplus (2)stanford.edu (3)reflections (4)alchetron

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু