সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-১৯) | Sagarparer Diary (Episode-19)
সাগরপারের ডায়েরি
পর্ব-১৯
আজকের প্রসঙ্গ : অনুষ্ঠান ও আনুষঙ্গিক
আজ আমাদের অনুষ্ঠান - সন্ধে ৬টা থেকে। বিকেল ৪টের মধ্যে পৌঁছনোর কথা অডিটোরিয়ামে। মাথার মধ্যে অনুষ্ঠানের যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। স্ক্রিপ্টটা নিয়ে বসলাম। পাশে শুভাশিষ নিশ্চিন্তে ঘুমের জগতে।
শুভাশিষ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে দীর্ঘদিন। নিজের বিষয় নৃত্যকলা। ভরতনাট্যম, ওডিসি, মনিপুরী নৃত্যে পারদর্শী ৫৫ বছরের এক তরতাজা যুবক। প্রত্যেক সকালে প্রাণায়াম করা, কিছু যোগাভ্যাস আর অল্প অনুশীলন না হলে শুভাশিষ তৃপ্ত হয় না। আমেরিকাতেও এর অন্যথা দেখিনি। গভীর নিষ্ঠা শুভাশীষকে এতো দীর্ঘকাল স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত রেখেছে - ভাবলে বন্ধুবরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারি না।
যথাসময়ে পৌঁছলাম প্রেক্ষাগৃহে। অপেরার মতো দেখতে মঞ্চের স্থাপত্য। নিউ জার্সিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু আর্ট সেন্টার - যেমন আমাদের কলকাতায় প্রত্যেক মিউনিসিপ্যালিটির একটি করে নিজস্ব মঞ্চ আছে, এখানেও তেমন দেখলাম। আর্ট সেন্টারগুলোর স্থাপত্যনির্মাণ একেকটার এক এক রকম - তাই মঞ্চের গড়নও স্বতন্ত্র। এই প্রেক্ষাগৃহটি যেমন বললাম, অপেরাধর্মী। আমাদের দেশের মঞ্চগুলোয় শিল্পী ও শ্রোতাদের মধ্যে যেরকম বেশ খানিকটা ব্যবধান রাখা হয় এবং সেখানে একটু উঁচুতে শিল্পীদের আলাদা ডায়াস বা বসবার জায়গা থাকে, এটি একেবারেই উল্টো। শিল্পীদের বসার জায়গাকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৭০° বৃত্ত ঘিরে শ্রোতাদের আসন। সুতরাং শিল্পী চাইলে গান গাইতে গাইতে প্রথম দিকের সারিতে বসে থাকা শ্রোতাদের সঙ্গে কথাও বলে আসতে পারেন। নিজে যখন অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করছিলাম, তখন বেশ ভাল লাগছিল, শ্রোতাদের এতো কাছে পেয়ে - তাদের Reactionগুলো অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করছিল।
আমাদের এই আমন্ত্রিত দলের অনুষ্ঠান ছিল সেদিনের সন্ধ্যার মূল আকর্ষণ। তাই প্রথমেই আমরা মঞ্চে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে আসন দখল করলাম। এবার সেই সংশয়ের মুহূর্ত - সাউন্ড সেট-আপ। Mr Mike এর সাথে আজ দেখলাম এক নতুন সহকারি। কি সৌভাগ্য ! তিনি ভারতীয় এবং ওদেশে সম্প্রতি ঠিকানা গেড়েছেন। ভারতে দক্ষিণ প্রদেশের নাগরিক - চেষ্টায় আছেন মার্কিন সরকারের সবুজ-সংকেত বা Green-Card পেলেই পাকাপাকিভাবে ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হবার। ওনাকে দেখে আমাদের উৎফুল্ল হবারই কথা। মার্কিন Mike ও ভারতের অ'মায়িক - দুইয়ে মিলে Sound-Checkএর কাজ নিশ্চিন্তে সম্পন্ন করা গেল। মোহনদা বললেন, 'আমি একেবারে বসেই যাই - আর উঠবো না। আমার একটু চা হলেই চলবে - গলা খুলে বাকিটা শুধু তাঁর সুর আর আমার কণ্ঠ। বুঝলাম, এটাই মোহনদার মনোনিবেশ করবার প্রক্রিয়া। হল-এর Acoustic বেশ ভাল লাগল।
আজকের অনুষ্ঠান শুরু হবে সমবেত সংগীতের মধ্যে দিয়ে - পরিবেশনায় থাকবে IIPAর সদস্যরা
- পরিচালনায় সুপর্ণাদি। তারপর রবিঠাকুরের ওপর লেখা একটি গ্রন্থের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। লেখক থাকেন লন্ডনে - তাঁর অগাধ পড়াশুনা রবীন্দ্র-সৃষ্টির উপর। ইংরেজি ভাষায় তিনি রবিজীবনী নিয়ে এক প্রবন্ধ লিখেছেন, সেখানে তথ্য ও লেখকের মনস্তত্ব মিলিয়ে ওই গ্রন্থ, আর তারির প্রকাশের কারণে বিদগ্ধ কিছু গুণীজনের সমাবেশ - যাঁরা মঞ্চে উপস্থিত থেকে গ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করবেন। শুনলাম, ওনারা নাকি খুব অধীর আমাদের অনুষ্ঠান শোনবার জন্য - প্রথমতঃ বিষয়-বস্তুর অভিনবত্ব ও দ্বিতীয়তঃ মোহনদার মত এমন এক কুশীলবের কণ্ঠের মাধুর্য সামনে থেকে সরাসরি আস্বাদন করা।
আবারও বলি, Live Performance-এর মজাটাই এখানে। এ একপ্রকার চ্যালেঞ্জ - ময়দানে নেমে শ্রোতার সঙ্গে শ্রুতির মেলবন্ধন গড়ে তোলা। যে সেই যোগসূত্র তৈরী করতে পারে - সেই জানে রসানুভূতির কোন তীব্র সীমায় গিয়ে সে উপস্থিত হয় ! আমি যে সময় থেকে সংগীতের আঙিনায় পা ফেলেছি, সেখানে সে সময় সস্তায় উপরির কোন আশা ছিল না। তাই যোগ্যতা প্রমাণের জন্য নিজের মুন্সিয়ানার বাইরে প্রগাঢ় অনুশীলনের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। কাঠ ভিজে থাকলে না তাতে ভাল আসবাব তৈরী হবে, না সে আগুন জ্বালবে। মোহনদা-বিপ্লবদা সেই জাতের শিল্পী - যারা আগুনের উত্তাপে নিত্য পুড়িয়েছেন নিজেদের, সাধনার দরবারে ফাঁকিতে বাঁধা পড়েন নি - সেখানে তাঁদের মৌতাতের আবাহন স্বতন্ত্র হবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাই এই অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আমার সংগীত-শিক্ষা আর তার সঙ্গে একেবারেই নিজস্ব ফরম্যাটের প্রস্তুতি বা হোমওয়ার্ক - অনুষ্ঠান শুরু হবার আগেই আমার চোখে সেলুলয়েডের আকারে সার্বিক ধরা পড়ে। আর যেদিন সেটা আমি আগাম দেখতে পাই, নিজের প্রতি বিশ্বাস ও সঞ্চালনার সমস্ত মুহূর্তগুলো মানসচক্ষে ভেসে ওঠে। এ আমার প্রতি আমার সংগীত-ঈশ্বরের অকৃপণ অনুকম্পা। আজকের অনুষ্ঠানের চালচিত্র ধীরে ধীরে মনের আয়নায় ফুটে উঠতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে থাকলাম প্রেক্ষাগৃহের পিছনের অন্ধকারের সরু চলনপথে - প্রকান্ড বটবৃক্ষের ছায়ায় নিমগ্ন পথিকের মতো - বটবৃক্ষ ক্রমশঃ আরো বড় আকার নিচ্ছে - বলে দিতে হবে না, এই বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথেরই বিশালত্বের অনুপ্রাস। যার অগণিত শাখা প্রলম্বিত হয়ে ঝুরির আকারে নেমে এসেছে ভূমিপৃষ্ঠে - রবিঠাকুরের নানা সৃষ্টির বাহ্যিক বিকাশ হয়ে।
আজ এমন একটি সন্ধে - আত্মবিশ্বাস আর দলগত নৈপুণ্যের প্রতি নির্ভরতা - এই দুইয়ে মিলে আমরা প্রত্যেকেই ফুটছি টগবগ করে, যেন ওয়ার্ল্ড-কাপ ফাইনাল খেলতে নামব। পাশ্চাত্যে প্রবাসী বাঙালির সামিয়ানার নিচে প্রাচ্যের সনাতন বাংলার সংস্কৃতির কলা-প্রদর্শণ।
আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি অনুষ্ঠান শুরু হতে - প্রথম বেল পড়ল। আমিও আজ বিরতি নিলাম - অনুষ্ঠানের বাকি গল্প আগামী পর্বে।
'সাগরপারের ডায়েরি'র পর্ব-২০ পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
আজ আমাদের অনুষ্ঠান - সন্ধে ৬টা থেকে। বিকেল ৪টের মধ্যে পৌঁছনোর কথা অডিটোরিয়ামে। মাথার মধ্যে অনুষ্ঠানের যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। স্ক্রিপ্টটা নিয়ে বসলাম। পাশে শুভাশিষ নিশ্চিন্তে ঘুমের জগতে।
শুভাশিষ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে দীর্ঘদিন। নিজের বিষয় নৃত্যকলা। ভরতনাট্যম, ওডিসি, মনিপুরী নৃত্যে পারদর্শী ৫৫ বছরের এক তরতাজা যুবক। প্রত্যেক সকালে প্রাণায়াম করা, কিছু যোগাভ্যাস আর অল্প অনুশীলন না হলে শুভাশিষ তৃপ্ত হয় না। আমেরিকাতেও এর অন্যথা দেখিনি। গভীর নিষ্ঠা শুভাশীষকে এতো দীর্ঘকাল স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত রেখেছে - ভাবলে বন্ধুবরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারি না।
![]() |
অপেরার মত দেখতে মঞ্চটা অনেকটা এইরকম ছিল |
আমাদের এই আমন্ত্রিত দলের অনুষ্ঠান ছিল সেদিনের সন্ধ্যার মূল আকর্ষণ। তাই প্রথমেই আমরা মঞ্চে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে আসন দখল করলাম। এবার সেই সংশয়ের মুহূর্ত - সাউন্ড সেট-আপ। Mr Mike এর সাথে আজ দেখলাম এক নতুন সহকারি। কি সৌভাগ্য ! তিনি ভারতীয় এবং ওদেশে সম্প্রতি ঠিকানা গেড়েছেন। ভারতে দক্ষিণ প্রদেশের নাগরিক - চেষ্টায় আছেন মার্কিন সরকারের সবুজ-সংকেত বা Green-Card পেলেই পাকাপাকিভাবে ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হবার। ওনাকে দেখে আমাদের উৎফুল্ল হবারই কথা। মার্কিন Mike ও ভারতের অ'মায়িক - দুইয়ে মিলে Sound-Checkএর কাজ নিশ্চিন্তে সম্পন্ন করা গেল। মোহনদা বললেন, 'আমি একেবারে বসেই যাই - আর উঠবো না। আমার একটু চা হলেই চলবে - গলা খুলে বাকিটা শুধু তাঁর সুর আর আমার কণ্ঠ। বুঝলাম, এটাই মোহনদার মনোনিবেশ করবার প্রক্রিয়া। হল-এর Acoustic বেশ ভাল লাগল।
![]() |
১৯৩০ নিউ ইয়র্ক - রবিঠাকুরের সঙ্গে মাত্র ১৯মাস বয়েসে বধির ও অন্ধ হয়ে যাওয়া বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হেলেন কেলার |
আবারও বলি, Live Performance-এর মজাটাই এখানে। এ একপ্রকার চ্যালেঞ্জ - ময়দানে নেমে শ্রোতার সঙ্গে শ্রুতির মেলবন্ধন গড়ে তোলা। যে সেই যোগসূত্র তৈরী করতে পারে - সেই জানে রসানুভূতির কোন তীব্র সীমায় গিয়ে সে উপস্থিত হয় ! আমি যে সময় থেকে সংগীতের আঙিনায় পা ফেলেছি, সেখানে সে সময় সস্তায় উপরির কোন আশা ছিল না। তাই যোগ্যতা প্রমাণের জন্য নিজের মুন্সিয়ানার বাইরে প্রগাঢ় অনুশীলনের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। কাঠ ভিজে থাকলে না তাতে ভাল আসবাব তৈরী হবে, না সে আগুন জ্বালবে। মোহনদা-বিপ্লবদা সেই জাতের শিল্পী - যারা আগুনের উত্তাপে নিত্য পুড়িয়েছেন নিজেদের, সাধনার দরবারে ফাঁকিতে বাঁধা পড়েন নি - সেখানে তাঁদের মৌতাতের আবাহন স্বতন্ত্র হবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাই এই অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আমার সংগীত-শিক্ষা আর তার সঙ্গে একেবারেই নিজস্ব ফরম্যাটের প্রস্তুতি বা হোমওয়ার্ক - অনুষ্ঠান শুরু হবার আগেই আমার চোখে সেলুলয়েডের আকারে সার্বিক ধরা পড়ে। আর যেদিন সেটা আমি আগাম দেখতে পাই, নিজের প্রতি বিশ্বাস ও সঞ্চালনার সমস্ত মুহূর্তগুলো মানসচক্ষে ভেসে ওঠে। এ আমার প্রতি আমার সংগীত-ঈশ্বরের অকৃপণ অনুকম্পা। আজকের অনুষ্ঠানের চালচিত্র ধীরে ধীরে মনের আয়নায় ফুটে উঠতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে থাকলাম প্রেক্ষাগৃহের পিছনের অন্ধকারের সরু চলনপথে - প্রকান্ড বটবৃক্ষের ছায়ায় নিমগ্ন পথিকের মতো - বটবৃক্ষ ক্রমশঃ আরো বড় আকার নিচ্ছে - বলে দিতে হবে না, এই বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথেরই বিশালত্বের অনুপ্রাস। যার অগণিত শাখা প্রলম্বিত হয়ে ঝুরির আকারে নেমে এসেছে ভূমিপৃষ্ঠে - রবিঠাকুরের নানা সৃষ্টির বাহ্যিক বিকাশ হয়ে।
আজ এমন একটি সন্ধে - আত্মবিশ্বাস আর দলগত নৈপুণ্যের প্রতি নির্ভরতা - এই দুইয়ে মিলে আমরা প্রত্যেকেই ফুটছি টগবগ করে, যেন ওয়ার্ল্ড-কাপ ফাইনাল খেলতে নামব। পাশ্চাত্যে প্রবাসী বাঙালির সামিয়ানার নিচে প্রাচ্যের সনাতন বাংলার সংস্কৃতির কলা-প্রদর্শণ।
আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি অনুষ্ঠান শুরু হতে - প্রথম বেল পড়ল। আমিও আজ বিরতি নিলাম - অনুষ্ঠানের বাকি গল্প আগামী পর্বে।
সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৯/চলবে ..........
'সাগরপারের ডায়েরি'র পর্ব-২০ পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy >HipPostcard/pinterest
মনমুগ্ধকর লেখনি যার এত সন্চালনা যে কি হবে আর দর্শক কি ভাবে গ্রাস করে অধির অপেক্ষায় শেষটুকু সাধ নেবার জন্য বসে থাকবে তা বেশ ভালো ই উপলব্দি করতে পারছি এ পারে বসে ও। 🙏
ReplyDelete