সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-১৮) | Sagarparer Diary (Episode-18)
সাগরপারের ডায়েরি
পর্ব-১৮
আজকের প্রসঙ্গ : ডঃ গুহ'র বাড়ি ও রিহার্সাল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হতোদ্যম, মনোবলহীন জার্মানরা যখন বেঁচে থাকার নতুন দিশা খুঁজছেন, সে সময় তাঁরা এমন একজনকে 'পরিত্রাতা' হিসেবে পাশে চাইছিলেন, যাঁর উপস্থিতি তাদের হৃত আত্ম-সম্মানকে পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে। জার্মানিতে পা রাখলেন রবীন্দ্রনাথ - প্রথমবার - ১৯২১ এ। জার্মানির সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর কবিতা ছিল মানবসত্ত্বার অন্তর্নিহিত সত্য ও আত্ম-চেতনার উপলব্ধি, রোমান্টিক সম্পর্কের গভীর অনুভব ও বৈষ্ণবশাস্ত্রের অহিংস, বিশুদ্ধ নীতি। তার প্রতি জার্মানজাতির গভীর অনুরাগ থাকবে এমন আশা করাটা হয়তো সমকালীন বা সময়োপযোগী ছিল না। আর তাছাড়া ১৯১৩র নোবেলপ্রাপক রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গীতাঞ্জলির কবিতার অন্তর্নিহিত অনুভূতি পাশ্চাত্যের কানে তখনও নতুন। তবু বিশ্বকবির বক্তৃতা শুনতে জার্মানির প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ - ইতিহাসই বলে দিয়ে গেছে সে কথা। আমরা রোমাঞ্চিত হই, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দ্বৈরথে সহচর না হয়ে সারথির হাতে সংস্কৃতির ধ্বজা উড়তে দেখে অনুপ্রাণিত হই। রবীন্দ্রনাথ যে একজন প্রকৃষ্ট সমাজ-সংস্কারক, সেই উপলব্ধিই আবার নতুন করে প্রমাণিত হয়।
দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর এসেছিলাম ডাক্তারের বাড়ি; তারপর সেখানে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মন এতটাই শুদ্ধ হয়ে উঠলো যে শরীরের প্রতিটি জীবন-কণিকায় আমাদের শ্বাশ্বত সংগীত নতুন জীবনের গান শোনাল - যেন ঘুম ভাঙলো আপনা থেকেই ঘুমিয়ে থাকা অনেক হৃদয়-তন্ত্রের। গঙ্গাস্নানের পর নিজের শরীর থেকে জল ঝরিয়ে নেবার মত পবিত্র অনুভূতি নিয়ে শুরু করলাম আমাদের মহড়া।
শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো করবার সুবাদেই হোক বা রবিঠাকুরের হাত ধরে বাংলার সংস্কৃতির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসার কারণেই হোক - সুপর্ণাদির ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহারে, গানের প্রতি সম্মান-প্রদর্শনে সেই ভাবধারা লক্ষ্য করে খুব মানসিক তৃপ্তি অনুভব করলাম। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা সত্ত্বেও বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগে কোনভাবেই ভাঁটা পড়ে নি। অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে তারা সমবেত গানগুলো অনুশীলন করলেন বাদ্যযন্ত্রীদের সঙ্গতের সঙ্গে। নানান ওঠা-পড়া রয়েছে সংস্থার অনুষ্ঠানের ভাবনা-চিন্তায়। বকলমে যা বলা যায় সুপর্ণাদিরই মস্তিস্কপ্রসূত গভীর রবীন্দ্র-চেতনার অনুসরণে এক উন্নত মানের বিচিত্রানুষ্ঠান - যার পুরোটাই রবীন্দ্র-সৃষ্টির সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে আকাশ-বাতাস-জলস্রোতের অবিনশ্বর উপাদানকে নিজেদের আয়নায় প্রতিফলিত করা - প্রতিবিম্বে অধরা মাধুরীকে শ্রোতাদের মনশ্চক্ষে ধরিয়ে দেওয়া।
কাজটা করতে গিয়ে নিজেও খুব উৎসাহ বোধ করছি। বিপ্লবদা ও সুপর্ণাদিকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম এই কাজে আমাকে যোগ্য মনে করে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে। আমার স্ক্রিপ্ট, সংযোজনা, মোহনদা-সহ সকলের গান ইত্যাদিতে ভরপুর মহড়া হল এবং আমরা সকলেই এই মহড়ায় নিজেদের বোঝাপড়ার সূত্রে মূল অনুষ্ঠানের উদযাপন সম্পর্কে বেশ খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করতে থাকলাম। প্রায় মাঝরাতে ডঃ গুহ'র নিজের হাতে বানানো চিকেন তন্দুরি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটের ঘর ছুঁয়েছে। কলকাতায় এখন শনিবারের বিকেল পাঁচটা। আমার বিছানার পাশেই রাখা ইন্টারকমে হাত রাখলাম। রিসেপশন-এর অপারেটরকে বললাম বাড়িতে যোগাযোগ করতে। প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলে একটু গা ভেজালাম হালকা গরম জলে। পরিশুদ্ধ মন আরও স্নিগ্ধ হল।
নিউ জার্সির আবহাওয়া এই সময় অতীব চমৎকার। দিনের বেলাতেও ঘাম হয় না - বাতাসে আর্দ্রতা ও দূষণ কোনটাই নেই। প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকার গভীর প্রশান্তি।
আগামীকাল আমাদের সেই দিন - যার প্রস্তুতিতে এই সময়-বিচরণ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঢলে পড়েছি ঘুমের কোলে। তাই আজ আর লেখা এগোনোর প্রশ্ন নেই। কাল অনুষ্ঠানের গল্প।
![]() |
১৯২১ - বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তা রবীন্দ্রনাথ |
দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর এসেছিলাম ডাক্তারের বাড়ি; তারপর সেখানে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মন এতটাই শুদ্ধ হয়ে উঠলো যে শরীরের প্রতিটি জীবন-কণিকায় আমাদের শ্বাশ্বত সংগীত নতুন জীবনের গান শোনাল - যেন ঘুম ভাঙলো আপনা থেকেই ঘুমিয়ে থাকা অনেক হৃদয়-তন্ত্রের। গঙ্গাস্নানের পর নিজের শরীর থেকে জল ঝরিয়ে নেবার মত পবিত্র অনুভূতি নিয়ে শুরু করলাম আমাদের মহড়া।

কাজটা করতে গিয়ে নিজেও খুব উৎসাহ বোধ করছি। বিপ্লবদা ও সুপর্ণাদিকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম এই কাজে আমাকে যোগ্য মনে করে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে। আমার স্ক্রিপ্ট, সংযোজনা, মোহনদা-সহ সকলের গান ইত্যাদিতে ভরপুর মহড়া হল এবং আমরা সকলেই এই মহড়ায় নিজেদের বোঝাপড়ার সূত্রে মূল অনুষ্ঠানের উদযাপন সম্পর্কে বেশ খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করতে থাকলাম। প্রায় মাঝরাতে ডঃ গুহ'র নিজের হাতে বানানো চিকেন তন্দুরি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটের ঘর ছুঁয়েছে। কলকাতায় এখন শনিবারের বিকেল পাঁচটা। আমার বিছানার পাশেই রাখা ইন্টারকমে হাত রাখলাম। রিসেপশন-এর অপারেটরকে বললাম বাড়িতে যোগাযোগ করতে। প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলে একটু গা ভেজালাম হালকা গরম জলে। পরিশুদ্ধ মন আরও স্নিগ্ধ হল।
নিউ জার্সির আবহাওয়া এই সময় অতীব চমৎকার। দিনের বেলাতেও ঘাম হয় না - বাতাসে আর্দ্রতা ও দূষণ কোনটাই নেই। প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকার গভীর প্রশান্তি।
আগামীকাল আমাদের সেই দিন - যার প্রস্তুতিতে এই সময়-বিচরণ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঢলে পড়েছি ঘুমের কোলে। তাই আজ আর লেখা এগোনোর প্রশ্ন নেই। কাল অনুষ্ঠানের গল্প।
সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৮/চলবে ..........
'সাগরপারের ডায়েরি'র ঊনবিংশ পর্ব (১৯) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'সাগরপারের ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy > wordpress / visva-bharati
Comments
Post a Comment