সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-১৭) | Sagarparer Diary (Episode-17)
সাগরপারের ডায়েরি
পর্ব-১৭
আজকের প্রসঙ্গ : ডঃ গুহ'র বাড়ি
'আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি
আমার চলা যায় না বলা' -
গায়ক ও শ্রোতার মেলবন্ধনে রবীন্দ্রনাথের গান বা রবীন্দ্রসংগীত কখনো থেমে থাকেনি। স্ক্রিপ্টটা প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে। শুনছি দেশ-বিদেশের অনেক রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ আসছেন এই অনুষ্ঠান শুনতে। কাজেই চাপা উত্তেজনার সঙ্গে একটু ভয় ভয়ও করতে লাগল।সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের ভাবনা, বিন্যাস, সঞ্চালনা - এ সবই যে আমারি হাতে ! 'এ মণিহার আমায় সাজবে তো' ?
চেম্বার-এর মত ডঃ গুহ'র বাড়িও মনোমুগ্ধকর। চারিদিকে রুচিবোধের পর্যাপ্ত উপস্থিতি। আর রবীন্দ্রনাথ - Basement-এর বসার জায়গা থেকে তিনতলা পর্যন্ত বাড়ির সর্বত্র তিনি রয়েছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডঃ গুহ'র স্ত্রী সুপর্ণাদি শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী। গুরুদেবের আশ্রমিক শিক্ষার প্রতিফলন বাড়ির প্রতিটি কোণে।
একটা মাত্র অমিল - বেশ মস্ত অমিল - লক্ষ্য করলাম। সুপর্ণাদির
প্রিয় প্রাণী 'পেঁচা'। হালফ্যাশনের Hobby গনেশের মত রকমারি চেহারার পেঁচা বিদ্যমান তিনতলার ড্রয়িং রুমে - ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে যে এরা কেউই জীবন্ত নয়। রবীন্দ্রনাথের পেঁচা-প্রীতি সম্পর্কে এখনো সেভাবে কিছু নজরে আসেনি।ডঃ গুহ'র কাঠের বাড়ি। মূল শহরের ব্যস্ততাকে ছাড়িয়ে অজস্র সবুজের মধ্যে অনেকটা জায়গা জুড়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা উঁচু করে। চারিধারে তারের বেড়া - জন্তুজানোয়ারের অনধিকার প্রবেশকে আটকাতেই এই ব্যবস্থা। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দেখলাম দু'চারটি হরিণ সামনের ছোট্ট দীঘিতে জল খেতে এল। হয়তো এতো নতুন অতিথিদের দেখে বেশি সময় না কাটিয়ে শিঙ উঁচিয়ে ছুটে পালাল সামনের জঙ্গলে।
আলাপ হল সুপর্ণাদির সম্পর্কে এক মামা'র সঙ্গে। ভদ্রলোকের বয়স ৯০ ছুঁই-ছুঁই। জার্মানিতে রয়েছেন দীর্ঘদিন। ইনিও শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন। সম্ভবত সে কারণেই মামা-ভাগ্নির সাংস্কৃতিক বন্ধন এতো জোরালো। ভদ্রলোকের পান্ডিত্যও দেখলাম নজরে পড়ার মত। আলোচনার শুরু থেকেই রবিঠাকুর। আমাদের প্রাক-সন্ধের আলোচনার প্রধান উপজীব্য যে তিনিই হবেন, এতে সন্দেহ থাকার কোন অবকাশ নেই - সান্ধ্যকালীন তুলসী মঞ্চে তাঁরই আরতি করি স্মরণে-বরণে।
'সব কলরবে সারা দিনমান শুনি অনাদি সঙ্গীতগান,
সবার সঙ্গে যেন অবিরত তোমার সঙ্গ রাজে'।
![]() |
জার্মানিতে কিশোর-বয়সীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ |
খেয়াল করেছি, শান্তিনিকেতন অ্যালুমনি-রা এতটাই সর্বজ্ঞান করেন রবীন্দ্রনাথকে যে - উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গানকে নতুন পৃথিবীর চেতনায় দেখতে কারোর কারোর গোঁড়ামিতে বাধে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, হালকা তর্কের আদান-প্রদান হল ভদ্রলোকের সঙ্গে। রবীন্দ্রসাহিত্য এনার এতটাই সুখপাঠ্য যে গুরুদেবের প্রায় সব উপন্যাস ও তার চরিত্রগুলি তাঁর এই অতিপ্রবীণ বয়েসের স্মৃতির মণিকোঠায় আশ্চর্যরকম জীবন্ত - জানতে পারলাম, জার্মানিতে গুরুদেবকে নিয়ে আজও আগ্রহের অন্ত নেই আর সেখানকার কয়েকটি উন্নত বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত - সুতরাং অবশ্যপাঠ্য। এ বড় গৌরবের - তাঁকে নিয়ে কাজ করতে সুযোগ পাচ্ছি এ আমার পরম সৌভাগ্য। কি চমৎকার তিনি উল্লেখ করলেন, 'এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় সাহিত্য আধুনিক পৃথিবীর আঙিনায় পা ফেলেছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। তবু বহু পন্ডিত বিশেষজ্ঞের মতে, যোগ্য হাতে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় তাঁর কবিতার সঠিক অনুবাদ হওয়ার আজও বিশেষ প্রয়োজন আছে, নইলে তাঁর বাংলা-কাব্যের অভ্যন্তরীণ রসমাধুরী আর গভীরতায় অভারতীয় মানুষ কেমন করে সিঞ্চিত হবেন'?
আলোচনা কিছুটা তোলা রইল আগামী পর্বের জন্যে। আজ এইটুকুই।
সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৭/চলবে ..........
©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy > (1) Wikipedia (2)parabaas
Comments
Post a Comment