সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-১৫) | Sagarparer Diary (Episode-15)

সাগরপারের  ডায়েরি
পর্ব-১৫
আজকের প্রসঙ্গ : ডঃ গুহ'র চেম্বার   

সমুদ্রপারের স্নিগ্ধ হাওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হল। বিচ থেকে ফিরলাম ডঃ গুহ'র চেম্বারে। নিউ জার্সি শহরটা যেন ঈশ্বরের নিজের হাতের তৈরী এক সাজানো বাগান। অপূর্ব Landscape, সবুজ মখমলের গালচে বিছানো শহরটার সারা শরীরে। কেমন এক মায়াময় ভালবাসার ছোঁয়া। বড় রাস্তা থেকে ডানদিকে হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে ডঃ গুহ'র প্রাসাদসম চেম্বার। রাস্তাটা চেম্বারকে ডানহাতে রেখে সামনের পাহাড়ি পথে এঁকেবেঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। 

চেম্বারের সামনে পার্কিং জোনে একটু পায়চারি করার খুব ইচ্ছে জাগলো। কফির কাপটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম নিচে। নানা সাইজের, নানা মডেলের গাড়িগুলো একটু গতি বাড়িয়েই বাড়ির পথে। চেম্বারের মত পার্কিং জোনটাও যথেষ্ট বড়। প্রায় খান দশেক গাড়ি আরামসে পার্ক করা যাবে। আসলে এখানে সরকারি নিয়মটাই এমন। পুরো আমেরিকা মহাদেশে রাজ্য এবং শহর অনুযায়ী বাড়ি বানানোর আলাদা আলাদা নির্দেশিকা আছে। সেগুলো অগ্রাহ্য করলে জরিমানার অংকে আরেকটি নতুন ফ্ল্যাট কেনা যায়। সুতরাং বলাই বাহুল্য যে নিউ জার্সি শহরের এই অংশেও একটি নির্দিষ্ট Land Measurement আছে। তার কমে ইচ্ছে থাকলেও জায়গা কেনা যাবে না - তাই বাড়িগুলো খোলামেলা হতে বাধ্য।

বাড়ির ভিতর থেকে উচ্চকিত কণ্ঠস্বর, হাস্যরোলের শব্দ কানে আসছে। বুঝলাম আসর বেশ জমে উঠেছে। রাত প্রায় দশটা বাজল। শহরটা ক'টায় ঘুমোবে কে জানে ! রাস্তার আলোকস্তম্ভগুলো ক্রমশ উজ্জ্বলতা বাড়াচ্ছে।
এমন সময় মোহনদার ছোটছেলে আবীর বাইরে এল। হাতে রঙিন পানীয় - মেজাজ বেশ ফুরফুরে। 'আরে তপনদা, তুমি এইখানে ? সবাই খুঁজছে ! চলো চলো, বাবা গান গাইবে, বিপ্লবদা তবলায় রেডি - তুমি হারোনিয়ামে বসবে'।

মোহনদা আগ্রা ঘরানার শিল্পী। দরাজ, উদাত্ত কণ্ঠস্বর। রাগনির্ভর রবীন্দ্রগানে মোহনদা একেবারে অপ্রতিদ্বন্দী - অন্তত এই মুহূর্তে। আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর কি হয়ত তারও আগে তরুণ মোহন সিং-এর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে আচার্য শান্তিদেব ঘোষ একটি মন্তব্য করেন - 'অনেকদিন পর ঠাকুরবংশের গান গাইবার স্টাইল তোমার গায়কীতে পেলাম। তুমি শুধু খেয়াল নয়, রবীন্দ্রসংগীতটাও নিয়মিত চর্চা করবে। তোমার কণ্ঠে রবিঠাকুরের গানও শ্রোতারা গ্রহণ করবেন।'

জহুরির চোখ জহর চিনতে ভুল করে নি। সে রাতের বৈঠকি মজলিসে আমরা বারবার তার প্রমাণ পেলাম। মোহনদার গানে হারমোনিয়াম সঙ্গত করতে করতে ভুলেই গিয়েছি যে ডিনার-এর সময় পার হয়ে গেছে। ওই পরিবেশে সংগীতই ছিল ক্ষুধানিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ রসমাধুরী। 


প্রসঙ্গত বলে রাখি, ঠিক এর পরের বছর ২০১২তে Ragranjani Music Company'র নিজস্ব রেকর্ড লেবেল থেকে মোহনদার রবীন্দ্রসংগীতের সিডি প্রকাশিত হয় - Unexplored মোহন সিং - সম্পূর্ণ এক অন্যরকম ভাবনায় সমস্ত গান রেকর্ড হয়েছিল। তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব আমার অন্য একটি কলমে - যার নাম 'দেখা না-দেখা' - তারও কাজ এগোচ্ছে। 

হোটেলে ফিরলাম ভোর সাড়ে চারটেয়। অনুষ্ঠানের সংগঠকদের উৎসাহের অন্ত নেই। ওই রাতের আসর ছেড়ে একজনকেও বাড়ি চলে যেতে দেখি নি। 'জোগান অল্প হলে চাহিদা বাড়ে' - Economics-এর এই Theory মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করলাম। 

কিছুক্ষণ বাদেই ভোর হবে - এখন আর স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসবো না মনস্থ করলাম।

এই পর্বের লেখাও এখানে ইতি টানলাম - কারণ কাল প্রবাসী মান্যগণ্য কিছু সংস্কৃতিপ্রেমীদের সঙ্গে মিটিং। অচেনা-অজানার মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজেকে বিশ্রামের মুখোমুখি করতে মন চাইল।   

To read the next episode, click here
To read the 1st episode in this series, click here
সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৫/চলবে ..........

©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy > Tapanbasu's collection

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু