সাগরপারের ডায়েরি (পর্ব-১১) | Sagarparer Diary (Episode-11)

সাগরপারের  ডায়েরি
পর্ব-১১
আজকের প্রসঙ্গ : রিহার্সাল ও যন্ত্রের যন্ত্রণা 


'Fine Arts' বিষয়টা এমনই যে তা যখন স্রষ্টার অন্তরে থাকে - তার পবিত্রতা থাকে সুরক্ষিত। কিন্তু যখনই তা লোকমঞ্চে আবির্ভূত হয়, তখনই তিনি সর্বজনীন - নানাজনের সংস্পর্শে কখনো রঞ্জিত, কখনো অতিরঞ্জিত, কখনো বা আত্ম-বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনে অতি-উপকারী কিছু হঠাৎ উপস্থিত হওয়া অবতারের ভূমিকায় অতি বিপন্ন। এ'রকম অনুষ্ঠানে সংগঠক, আয়োজক, পরিচালক, টেকনিকাল কাজের দায়িত্বে থাকা মানুষ-জন, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকা থাকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটি অপরটির ওপরে নির্ভরশীল। উপরোক্ত বিষয়গুলো যখন একসূত্রে সংগঠিত থাকে, তখন মঞ্চের উপর অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে আসা শিল্পীদের মানসিক যোগসূত্র অনেক উচ্চ তারে বাঁধা পড়ে। শ্রোতারা এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন,  সারাজীবন মনে রাখার মত এক স্মরণীয় অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে ওঠেন শুধু এই কারণেই প্রত্যেক অনুষ্ঠান তার সামগ্রিক উপস্থাপনায় আলাদা আলাদা চরিত্র সৃষ্টি করে, বিভিন্ন রূপে তা সর্বকালীন গ্রহণযোগ্যতা পায় । যে কারণে মঞ্চ-গান, মঞ্চ-নাটক এতটা উৎসাহ-ব্যাঞ্জক আর challenging।

সবই মোটামুটি ঠিক ছিল, যেখানে একটু ভয় ছিল আমার - পুরনো অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে - সেখানেই গন্ডগোল ধরা পড়লো। অসাধারণ সমস্ত শব্দ-প্রক্ষেপণের উপকরণ - কিন্তু যিনি Sound Engineer - তালগাছের মত লম্বা, গায়ের রং অক্সফোর্ড ব্র্যান্ড-এর A4 Paper-এর মত সাদা, আর সর্বোপরি তার উদ্দেশ্যহীন দুই চোখের নীল চাহনি দিয়ে আমাদের প্রায় পেড়ে ফেললে। না সে ইংরেজি শুনবে - (গোটা ও ভাঙ্গা - দুভাবেই চেষ্টা করে দেখেছি) - না সে কোন যন্ত্রে হাত দিতে দেবে। ওনার কাছে সাউন্ড মানে যেটা তা হল, মঞ্চে শিল্পী যা বাজাবেন বা গাইবেন, তা ওনার হাত ঘুরে শ্রোতাদের কানে পৌঁছবে। শ্রোতাদের দায়িত্ব তা পরিশ্রুত করে নেওয়া। তার কান ও মস্তিস্ক এমন ওজস্বীতায় ভরপুর হতে হবে যে, মঞ্চে শিল্পীর (তিনি যেই হোন না কেন) কণ্ঠস্বর ও যন্ত্রের সূক্ষ মূর্ছনা শ্রোতাকে আপন গুণে
নবরত্ন সভায় সম্রাট আকবরের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে -  যেখানে সুরসম্রাট তানসেন স্বর্গীয় সুরের মায়াজাল রচনা করছেন, আর সম্রাট মোহাবিষ্ট হয়ে শুনছেন। এহেন কাল্পনিক শ্রোতাসৃষ্টি যিনি করতে পারেন, তিনি যে বেশ বড়োসড়ো সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, তাতে তো সত্যিই কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। কথা হল, বাস্তব বলছে এমন বিপদে আমি জীবনে পড়িনি। কিন্তু এর পরেও আমি একটা কথা বলব, সব দোষ ওনাকেও দেওয়া উচিত নয়। আমাদের বাংলা গানের যে সূক্ষ্ম সংলাপ-ভিত্তিক বাণীপ্রধান সুরালাপ, তার জন্যে শিল্পীর কণ্ঠ, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি সব কিছুকেই সাউন্ড কনসোলের মাধ্যমে ব্যালান্স করে একটা noiseless ambience তৈরী করতে হয়। সেক্ষেত্রে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের ভাষাজ্ঞান জরুরী। কারণে এই liaison-র দায়িত্ব সুপর্ণাদি নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন তাঁর শিক্ষায়তনের ছাত্র-ছাত্রীদের সমবেত গানের সময় বেশি সংখ্যক মাইক্রোফোন প্রয়োজন, আর তার ব্যালেন্সিং নিয়ে সত্যিই সমস্যা হচ্ছে, তখনই তাঁকে একটু উৎকণ্ঠিত হতে দেখলাম।

"পরবাসে এসে, ডুবিলাম শেষে" - এই উদ্ধৃতি যখন বড় আপনার মনে হতে শুরু করেছে, তখনই বিদ্যুৎচমকের মত একটা আইডিয়া - নিশ্চিত বলতে পারেন এক অতি সাধারণ মানের আইডিয়া, যা অতীতে  আমায় প্রতিকুল পরিস্থিতিতে উদ্ধার করেছে - সেটা মাথায় এল। কারণ আমি বহুবার দেখেছি, অতি চালাকের সঙ্গে কোন কোন ক্ষেত্রে অতি বোকামির নিদর্শন তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। তার যাবতীয় বড়াই ক্ষনিকের জন্যে হলেও ধাক্কা খায়, আর সেই সুযোগে নিজের কাজ হাসিল করে নেওয়াটাই সেই পরিস্থিতিতে একমাত্র উপায়। আমি করলাম কি, প্রতিটি মাইক্রোফোনেই নিজেরই আওয়াজকে ছোট-বড়ো-কম-বেশি করে balance করলাম। আর সেটা করা হল কোন কোলাহল না করে। চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে ওনার মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারি। এইভাবে প্রতিটি মাইক্রোফোন আলাদা একটা Preset mode-এ নির্দিষ্ট রেখে সকলের সম্মিলিত সুরারোপের সময় বাকি কাজটুকু সাউন্ড কনসোল-এ বসে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার-কে উৎসাহ দিতে দিতে করিয়ে নেওয়া। একটা আলাদা ছোট ১৬ চ্যানেল কনসোল থেকে সমবেত শিল্পীদের কণ্ঠ Pre-set Mix Output মূল কনসোলে গিয়ে যুক্ত হল । সাউন্ডটা দাঁড়িয়ে গেল। আসলে এ এক সংযুক্ত প্রচেষ্টা - এই Sound Engineer কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে। মনে রাখতে হবে, ইনিই কিন্তু পাশ্চাত্যে একজন Drummer-এর ক্ষেত্রে ২৫টি মাইক্রোফোনের ব্যালান্স করেন।  

উপরোক্ত ব্যবস্থায় ম্যাজিকের মত কাজ হল, কিন্তু তা মূল অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের জন্যে আদৌ দাঁড়ালো কিনা বলতে পারি না - কারণ আজ তো সবে স্টেজ রিহার্সাল। এরই মাঝে শুভাশিসের একক নাচের অনুশীলন উপস্থিত সংগঠকমন্ডলী  দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হল - কারণ ওখানে কোন সাউন্ড ছিল না। 

ভাল-মন্দের দোলাচলে মঞ্চ ছাড়লাম ও বাইরে এসে হোটেলে ফেরার অভিপ্রায়ে গাড়িতে চাপলাম।

সাগরপারের ডায়েরি/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১১/চলবে ..........

'সাগরপারের  ডায়েরি'র পর্ব-১২ পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 
'সাগরপারের  ডায়েরি'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy > quora 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু

তপনের ডায়েরি ৬ / ৩০ আগস্ট ২০২১