বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-৫) | Baro Bismay Jaage (Episode-5)
বড়ো বিস্ময় জাগে........
পর্ব-৫ | প্রসঙ্গ : "তুমি রবে নীরবে"
আগের দুটি পর্বে 'তুমি রবে নীরবে' গানটি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছি। মজা লাগে ভাবতে, বেহাগ রাগ মূলত ঠাট বিলাবলের অঙ্গ। পুরনো মতে সেখানে তীব্র মধ্যম লাগত না। অথচ এখন এর সঙ্গে বক্রগতির তীব্র মধ্যম প্রায় অচ্ছেদ্য। তাই অনেক সঙ্গীতজ্ঞের মতে, এই রাগকে কল্যাণ ঠাটের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
গুরু শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করলাম,'সাধারণত গানে দুই অন্তরাতেই একই সুর লক্ষ্য করা যায়। এই গানে স্বরলিপি পড়ে দেখলাম সামান্য একটু আলাদা।'
দাদা দুই অন্তরার ৩য় সপ্তকে পঞ্চম-এর ব্যবহার বোঝালেন এবং গেয়ে দেখালেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম - 'অখিল ভুবন' আর 'সফল স্বপন'-এ ভাষাগত আবেদন সুরের অববাহিকায় কি মূর্ছনা সৃষ্টি করতে পারে ! দুটি ক্ষেত্রেই তিনি পঞ্চমে কণ্ঠের আলাদা স্থিতি দিলেন। আওয়াজের ওজন আর দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর ভয়েস মুভমেন্ট লক্ষ্য করলাম একই সুর-বেষ্টনীর মধ্যেই রয়েছে, কিন্তু স্বর-প্রয়োগের তারতম্যে ভিন্ন গায়নভঙ্গী নির্দেশ করছে (স্বরলিপি দ্রষ্টব্য)। রবীন্দ্রসংগীতের সুর-সংযোজনে detail-এর এতো নিপুণ উদাহরণ আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। আর তা যদি কোন ঋদ্ধ গায়ক কণ্ঠে ধারণ করেন তখন তার সামগ্রিক প্রতিফলন হয় একেবারে স্বতন্ত্র।
"সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা"......
মূহ্যমান হয়ে বাড়ি ফিরতাম, আজও মনে পড়ে।
আজ এই সময়ে তাদের ফিরে ফিরে দেখি, আর মন বেরিয়ে পড়ে বর্তমানের হাত ধরে ইচ্ছের স্রোতে। সেখানেও আলাদা বোধ, নতুন বিস্ময়।
আজ এই সময়ে তাদের ফিরে ফিরে দেখি, আর মন বেরিয়ে পড়ে বর্তমানের হাত ধরে ইচ্ছের স্রোতে। সেখানেও আলাদা বোধ, নতুন বিস্ময়।
গান রচনা হয়েছে present-future tense-এ। 'রবে', 'ভরিবে', 'জাগিবে' ইত্যাদি শব্দের নির্বাচনই তার প্রমাণ। সিনেমা'র আঙ্গিকে ধরে নিই নায়ক ভুলতে পারছে না প্রিয়তমার বিরহ - তার একাত্ম সঙ্গী হয়ে থাকবার স্মৃতি। নীরবে অস্ফুটস্বরে সে নিজের মধ্যে আত্মস্থ হয়ে গাইছে 'তুমি রবে নীরবে - আমার একান্ত আপনার হয়ে - আমার জীবনে-যৌবনে, স্বপ্ন-সফলতায়, দুঃখ-বেদনায় - আমি যেখানেই থাকি, আমায় ঢাকা দিয়ে রাখবে একাকী 'তুমি'র সেই নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতির মায়াময় অঞ্চলছায়া'।
তখন সে গান কি আর বহির্জগতের শোনবার জন্যে আহূত হয়? বিস্মৃতির অন্তরালে থাকা সেই নায়িকার জন্যে বিরহী মনের আকুল ক্রন্দন - নিজের জীবন-যুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রতি মুহূর্তে অতি ভালবাসার একজন মানুষের অ-শরীরী উপস্থিতি। তখন গায়ক-নায়ক সত্ত্বা একাকার - এ গান তো শুধু তার একলা বলবার - যা কেউ শুনতে পাবে না - অন্যের চোখের জলে ঝাপসা হবে না প্রিয়তমার নিশীথরাতের উপস্থিতির অনুভব। তখন এ গান সত্যিই বিরহ-প্রেমের - একাকী গায়কের । পৃথিবীর কোন গভীর গোপন কোণে হয়তো মিলবে গায়কের বেদনা - শ্রোতার শ্রুতিসৌন্দর্যে - কেউ জানে না।
বিরহ যে কখনো কখনো হতে পারে প্রিয়জনের মৃত্যুর চেয়েও হৃদয়-বিদারী - অসহনীয় দুঃখের অনুপ্রাস। তখন আর শোকের আবহে এই গান ব্যবহারে বাধা থাকে না। তাকে বেঁধে রাখাও যে যায় না কোন এক সূত্রের চিন্তার আবদ্ধজালে। পূজা-প্রেম-প্রকৃতি তখন একাকার হয়ে ওঠে, সংগীতের বৃহত্তর আঙিনায়।
এখানেই তো রবিঠাকুরের বিশালত্ব। তাঁকে মাপতে চাওয়া নির্ভেজাল ধৃষ্টতা - বুঝতে যাওয়া 'আরো বড়ো বোঝা'।
এখানেই তো রবিঠাকুরের বিশালত্ব। তাঁকে মাপতে চাওয়া নির্ভেজাল ধৃষ্টতা - বুঝতে যাওয়া 'আরো বড়ো বোঝা'।
তাই....... 'তুমি যত ভার দিয়েছ, সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা,
আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি, সকলি হয়েছে বোঝা'।
এও কি বিস্ময় নয় ?
বড়ো বিস্ময় জাগে/তপন বসু/পৃষ্ঠা-৫/চলবে ......
ⓒ Tapan Basu. All rights reserved
picture courtesy > tapanbasu
Comments
Post a Comment