বড়ো বিস্ময় জাগে পর্ব-৪ | Baro Bismay Jaage (Episode-4)

বড়ো বিস্ময় জাগে........
পর্ব-৪

প্রসঙ্গ : 'তুমি রবে নীরবে'


আগের পর্বে বেশ কয়েকটি আঙ্গিক থেকে গানটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিছু তথ্য, কিছু বিশ্লেষণ - এই নিয়ে গানটির শৈল্পিক চিত্রকল্প বিস্ময়কর। আজকের পর্বে আমার রবীন্দ্রসংগীত-গুরুর কাছে বসে শেখার অভিজ্ঞতা এবং প্রবীণ বয়েসের আঙিনায় পা ফেলা একজন রবীন্দ্র-অনুরাগীর চোখে ধরা পড়া এই গানের অন্য রূপ বর্ণনা করবার চেষ্টা করবো।  


আমার সংগীতগুরু শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় একদিন এই গানটি আমাদের শেখাচ্ছিলেন। 'হৃদয়ে মম' সুরটির আন্দোলন কিভাবে হওয়া উচিত সেইটি গেয়ে দেখাতে গিয়ে বললেন, 'রবে নীরবে' আর 'হৃদয়ে মম' - দুটি ক্ষেত্রেই সুরবিন্যাস হয়েছে ১১ মাত্রায়। অথচ ২য় ক্ষেত্রে মনে হয় যেন অনেক বেশি সময় ধরে সুর প্রলম্বিত হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে কণ্ঠের ব্যবহার ও ওজন তফাৎ না করলে একটা monotony তৈরী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এইটাই তোমরা যখন গাইবে, স্বরলিপি ভালো করে পড়বে। তাহলে এই সুরের বৈচিত্র্য তোমাদের নজরে আসবে।

আমাদের প্রতি রবিবারের গানের ক্লাস নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হত এবং একে একে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা বিদায় নিত। তখন দাদা থাকতেন শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। বলতে খুব গর্ব অনুভব হয়, আজ ওই রাস্তার নামকরণ হয়েছে 'দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সরণি'। দাদার ওই বাড়ি থেকে আমার বাড়ি পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। তাই আমার যাবার কোন তাড়া থাকত না। এছাড়া আমি লক্ষ্য করেছিলাম আমার এই বাড়তি সময় কাটানোতে গুরুদেবের নীরব প্রশ্রয় ছিল। এবং 'গীতা'র বাণী অনুসারে আমি ওই প্রশ্রয়ে মাথায় চড়ে বসেছিলাম - নানা প্রশ্নবাণে আমার যাবতীয় ক্ষুধার নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিদায় নিতাম না। দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের নির্ধারিত সময় যে কখন এসে দরজায় কড়া নাড়ত তা বুঝতেই পারতাম না - সময় কেটে যেত কথায়-কথায়। গভীর বোধের সংক্রমণ হতো এক বালক বা কিশোরের মস্তিষ্কে। চমক ভাঙতো দোতলা থেকে বৌদির ডাকে - আমার অপরাধী মন সংকুচিত হত, দাদার সাথে আলোচনায় ইতি পড়ত। কিন্তু যাবার সময় কখনোই খালি হাতে বৌদি আমায় যেতে দিতেন না। কিছু না কিছু উদরপূর্তি আর গানের ক্লাসের অনাবিল প্রাপ্তির আনন্দে নিমেষে বাড়ি পৌঁছে যেতাম। এ ভালোবাসার কথা অন্যত্র বলবার ইচ্ছে রইলো, যদি সুযোগ পাই। 

এবার সেই বাড়তি আলোচনার সুযোগ। দাদা বললেন, 'রবীন্দ্রনাথ কখনোই বলেননি, আমি অমুক গানটি তমুক রাগে বেঁধেছি বা গায়নকালে ওই রাগটিকে মাথায় রেখে তবেই গাইতে হবে। তাঁর গানকে যেমন কোন সীমানায় বাঁধাটা বোকামি, তেমন তাঁর কোন কাজ বা সৃষ্টির পর্যালোচনা করতে গেলে নিজের বোধ ও দৃষ্টির উদারতা থাকাটাও জরুরি বলে মনে হয়। তপন, নিজের কান ও মন খোলা রাখবে। যেখানে সেখানে কেউ বললেই গান গাইতে চলে যেও না। ঠাকুরকে মনে মনে পুজো করতে পারলে তবেই তাঁকে বুঝতে পারবে।'

আমি বললাম, 'বুঝতে যে পারছি, তা আমি কেমন করে বুঝব ?'

কিছুক্ষন নীরব থেকে দাদা বললেন,'সেদিন তোমার ভেতরে একটা যন্ত্রণা উপলব্ধি করবে। কিছুতেই শান্ত হতে পারবে না। নানা প্রশ্ন, গানটি গাইবার ক্ষেত্রে নানা আবেদন, তোমার মনে উঁকি-ঝুঁকি দেবে।'

সেদিন কুড়ির কোঠা পার করা আমার পক্ষে সে বোঝার ভার বোঝবার ক্ষমতা ছিল না। আজকেও যে আছে তা জোর গলায় বলতেও পারি না। তবে প্রতিটি ক্লাসের পরে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া ওই গভীর অনুভবের বিশ্লেষণ আজ আমার মর্মে মর্মে ছায়া রেখে গেছে। তাই অনেক কথা বলবার পরেও এই একটি গান থেকে আমি বেরোতে পারছি না।  যন্ত্রণার সেই অনুভবের কথা আজ থাক, পরের পর্বে তুলে ধরবো আমার শুভানুধ্যায়ী পাঠকদের জন্যে। 



তপন বসু / পৃষ্ঠা-৪ / চলবে  ......
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (৫) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

ⓒ Tapan Basu. All rights reserved
PC >(1)private; (2)amajon.in






Comments

  1. Ami prothokkho sakkhi tomar proti poreo je dadar tan kotota chilo.r kototai rag abhiman o chilo tomay niye. sontan er proti thik jemon tar babar thake.lekhata pore anek tripti pelam.gan sikhechi amrao kintu bhitore sobai dhukte parini ja tumi perecho tai ei sundor lekhate kichuta holeo ganke chinte sikhlam.pronam nio.ami apluto tomar moton o ekjon sikkhok peye je sudhui gan sekhay na ganke bhalobasay.🙏🙏🙏

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১