বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-৩) | Baro Bismay Jaage (Episode-3)
বড়ো বিস্ময় জাগে........
পর্ব-৩
গান একাকী গায়কের নয়। গীতিকার-সুরকার-গায়ক, এই তিন জনকে যদি আমরা আলাদা সত্ত্বায় দেখি তাহলে হয়তো প্রত্যেকের কাছেই তার নিজস্ব অনুভব খুঁজে পাব। কিন্তু সেই অনুভবের স্বরলিপি শুধু খাতার পাতায় এঁকে দেওয়া যায় না। তবু আমি চেষ্টা করবো নিছক তথ্যের বাইরে গিয়ে একজন সংগীত-পিপাসুর অন্তর্দৃষ্টিকে তুলে ধরতে - এই পর্বে। যেহেতু এখানে গীতিকার ও সুরকার একই ব্যক্তি এবং তাঁর কণ্ঠে এই গান আমাদের শ্রুত নয়, সুতরাং গায়কের আবেদন তার নিজের ওজস্বীতার মাপকাঠিতে তোলা থাক।
" তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম "
এই গানে বারেবারে একটি শব্দ গজলের আঙ্গিকে ফিরে ফিরে আসে - 'নিশীথিনীসম' । এ গান আমাকে-আপনাকে টেনে নিয়ে যায় নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা রাতে - একা। যাবতীয় সুখ-দুঃখ-বেদনা নিয়ে যেখানে প্রিয়তমা রয়েছে 'নিশীথিনীসম'; অনুরাগের আপন ও একাত্ম সঙ্গী হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ কোন এক সময় গভীর আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় মন্তব্য করেছিলেন, 'সকলের নয় যে আঘাত, ধোরো না সবার চোখে'। প্রেম যখন অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে প্রতিভাত, কি প্রয়োজন তার বিলাসী বহিঃপ্রকাশে ? এইখানেই উত্তীর্ণ হয় গায়কের প্রতিভা। তার কণ্ঠ ও মস্তিষ্কের যুগল ব্যবহারে শ্রোতার মন আপনা হতেই পৌঁছে যেতে পারে সৃষ্টির ঠিকানায়। তখনি গান হয়ে ওঠে কালজয়ী।
এই গানটিও আত্ম-নিমগ্ন এক এককের অন্তরের প্রকাশ - যেন অসীম আকাশের নীচে লোকচক্ষুর অন্তরালে মনের কথা মনের মানুষকে শোনানো । সুরে রাগ বেহাগের ছায়া। মৃত্যুর সাপেক্ষেও এই গানটি বহুবার বহুভাবে ব্যবহৃত হতে তো দেখি, বিশেষ করে গানটির প্রথম লাইন তো অহরহ দেখা যায় শোকসংবাদের বিজ্ঞাপনে । গানটি রয়েছে গীতবিতানের প্রেম পর্যায়ে, প্রেম-বৈচিত্র্যের উপ-পর্যায়ে। কাব্যের ব্যঞ্জনায় এই প্রিততমা নারী-চরিত্রটি বক্তার কাছে সবচেয়ে বড় বিশ্বাস ও আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। গভীরতায় এ প্রেম স্বর্গীয় - প্লেটোনিক। যেখানে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া নেই। নতুন প্রেমের উদ্দামতা যেমন আমরা প্রত্যক্ষ করি 'প্রেমের জোয়ারে' গানে।
'তুমি রবে নীরবে'কে স্বগতোক্তির গান বলা যেতে পারে। যার প্রতি বক্তা বা গায়কের এই আবেদন, তিনি যে হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটি নায়কের কণ্ঠের গান, যিনি প্রেমকে নিবেদন করেছেন পূজার আহূতিতে (প্রথম স্তবকেই সেটি স্পষ্ট) আর সেখানেই গানটি উত্তীর্ণ হয়েছে রবীন্দ্রগানের প্রেম পর্যায়ের অন্যতম সেরা নিদর্শন হিসেবে। তার প্রমান পাওয়া যায়, যে কোনো মিউজিক প্লাটফর্মে এই গানটি কতবার গাওয়া হয়েছে, তা নজর করলেই।
রবীন্দ্রসৃষ্টির মুন্সিয়ানা এখানেই। আমাদের চিন্তার আলোয় সর্বদাই নতুন করে ভাবনার পথ দেখায়। তাই তাঁর অসামান্য সব শিল্পকীর্তিতে স্রষ্টার যেমন একটা চিন্তার ফসল রয়েছে, তেমনি পাঠক-শ্রোতার জন্যেও এগোবার রসদ মজুদ রয়েছে - 'তোমায় নতুন করে পাবো বলে' ।
গুরুদেবের কাব্যসৃষ্টির গভীর উৎস যে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে, তা বোঝা বেশ আয়াস-সাপেক্ষ, কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ দুষ্কর। এটি কবির ৩৪ বছর বয়েসের রচনা (অক্টোবর,১৮৯৫)। যদি গানটিতে রাগের প্রভাব সম্পর্কে ভেবে দেখি, তাহলে বেহাগ রাগ সাধারণত গাইবার সময় রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর । কি আশ্চর্য ? এ গানের কথা তো সে সময়কেই নির্দেশিত করছে, তাই না ?
এই গানেরই সঞ্চারী অংশে 'জাগিবে একাকী, তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি' - এ এক অতুলনীয় দৃঢ়তা । তার স্নেহের আঁচল আগলে রাখবে আমাকে - এহেন দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারা যায় হৃদয়ের গভীরে থাকা এমন একা 'কোন জন' ? তিনি তো আমার 'মা'ও হতে পারেন। যিনি সন্তানকে আগলে রাখেন তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়ে - স্নেহের ছত্রছায়ায়। আবার যদি প্রকৃতির কথায় আসি - যেহেতু বারবার এই গানে গভীর রাত্রির কথা বলা হয়েছে - সেখানে তো অসীম আকাশও হতে পারে আমার একান্ত সেই প্রেক্ষিত প্রেয়সী। যার বিশাল আঁচলের নিচে এই পূর্ণিমারাত্রি শুধুই আমার একার ।
এতো কিছু একসাথে মাথায় রেখে কোন নতুন শিল্পসৃষ্টি কি আদৌ সম্ভব ?
বিস্ময় কি জাগে না !
বিস্ময় আমার আরো জেগেছিল আমার সদ্য-প্রয়াত সংগীতগুরু শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কাছে গানটি শিখতে বসে। সে আলোচনা পরের পর্বের জন্য তোলা রইল।
তপন বসু / পৃষ্ঠা-৩ / চলবে। ......
ⓒ Tapan Basu. All rights reserved
Comments
Post a Comment