সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-১৫ । শেষ পর্ব

 সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-১৫। শেষ পর্ব 

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 1st March 2020 । রবিবার ,সকাল আটটা .........

সেলুলার জেল

শেষ পৃষ্ঠার আন্দামানের কাহিনী শেষ হবে এয়ারপোর্টে বসে। সিকিউরিটি চেক হয়ে গেছে। স্বপ্না ও তৃপ্তিবৌদি চোখের আড়াল হয়েছে, এয়ারপোর্টের স্টোরগুলো ঘুরে দেখতে। যেটুকু অর্থ তলানিতে আছে, তার সদ্ব্যবহার করতে। এই নিজেকে একলা পাবার মুহূর্তকে আমি কাজে লাগাতে ডায়েরি নিয়ে বসলাম। গতকাল ব্রেকফাস্ট করে আমরা গেছিলাম সাউথ আন্দামান-এর একটি local beach-এ। আন্দামানের এই দিকটা বেশ বর্ধিষ্ণু - ধনবানরা থাকেন মনে হলো।  বোম্বের জুহু বিচ টাইপের। মাঝামাঝি অঞ্চলে অনেকটা জায়গা জুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন, সমুদ্রতীর ঘেঁষে। আমাদের বাস সমুদ্রকে বাঁহাতে রেখে পরিচ্ছন্ন রাস্তার বুক চিরে অর্ধচক্রাকৃতি গতিপথে এগিয়ে গিয়ে অপূর্ব এক স্থানীয় বিচের প্রবেশপথে থামল। নাম দেখলাম বেশ বাহারি করে লেখা - 'Carvyns' Cove'। কি চমৎকার সাজানো !


একটু গরম পড়েছে, তাই লোক নেই বললেই চলে। তবে এই Beach অনেকটাই কৃত্রিম ; মানুষের হাতে সাজানো - কিন্তু পরিবেশ দূষণ বা দৃশ্যদূষণের বালাই নেই। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, অতি উৎকৃষ্ট ডাবের জল খেয়ে চললাম সেলুলার জেল দেখতে। আগের দিন 'লাইট & সাউন্ড' দেখেছিলাম - আজ জেলের ভিতরে ঢোকা, মুক্ত অবস্থায়। টিকিট কাটাই ছিল, প্রবেশে বেগ পেতে হলো না। একজন হিন্দিভাষী গাইড দেখলাম আমাদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছেন, তাঁর হাত ধরেই এগোতে শুরু করলাম, পিছনের কাহিনীকে ফিরিয়ে আনতে।


ডঃ বক্সী
জেলে প্রবেশের পর ডানদিকে প্রথমেই ফাঁসিঘর - শুরুতেই শেষের কবিতা। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস মনে পড়লে এই ফাঁসিঘরের দিকে তাকিয়ে থাকা অসম্ভব। কি জানি কেন, আজ এই সব দেখতে ভাল লাগছিল না। ব্রিটিশ অত্যাচারের নির্মম কাহিনী, ব্রিটিশ ভারতের শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত বহু ফিরিস্তি নানা বইতে আমাদের ছাত্রাবস্থায় অবশ্যপাঠ্য। আর তাছাড়া আমার প্রাথমিক অভিব্যক্তি প্রথম দিনের বর্ণনায় বেশ কিছুটা লিখেছি। আজ দেখলাম সাভারকারের কুঠুরি - যেখানে তার দশ বছর সময় কেটেছে। আমাদের দলের কেউ কেউ বললেন,'আসলে সাভারকারকে নিয়ে যথেষ্ট পলিটিক্সও হয়েছে তখন। সাভারকার উল্টে বরং ব্রিটিশকে সহযোগিতাই করতেন নানা উপায়ে, নইলে এই মৃত্য়ুকুঠুরিতে বর্বরোচিত অত্যাচারে কেউই দশ বছর টিকতে পারে না'। এখানেও সেই সন্দেহ - দুশ্চিন্তা কারণ-অকারণ।


ফাঁসি-ঘর
কিছু আলটপকা মন্তব্য সময়-অসময়ে বেশ পছন্দসই হয় আর বিশ্বাসযোগ্য লাগে। আমারও তাই হলো। বেশি কথা না বাড়িয়ে মিউজিয়ামের দিকে এগোলাম। সেখানে নেতাজির নানা কীর্তিকলাপের দিনলিপি রয়েছে। রয়েছে তাঁর হাতে লেখা কিছু নথি-পত্র আর দুষ্প্রাপ্য ছবি - রোমাঞ্চিত হলাম। আমার বংশলতিকা অনুযায়ী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আমার পূর্বপুরুষ। আমার সিংহ রাশি, অমন বীর বিক্রম পূর্বপুরুষের গরিমাতেই হবে হয়তো। তবু সামান্য একটু কাগুজে মিল পেয়ে চাপা আনন্দকে চাপতে পারলাম না। যদিও তুলনায় গেলে পুরোটাই আফসোশ।

কি আর করা যাবে ! এখানে ছবি তুলতে কেন জানি না মন চাইল না। তাছাড়া আমাদের বেড়ানোর মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। সদ্য পাওয়া নতুন বন্ধুদের এবার বিদায় জানানোর পালা। একটু ভারাক্রান্ত মন নিয়েই Samudrika Marine Museum দেখতে গেলাম। সরকারের নিজস্ব পরিচালনাধীন কাঠা দশেক জমিতে তৈরী এই মিউজিয়াম। সংগ্রহ খারাপ নয়, যা জলের তলায় থাকে - তা এখানে মাটির উপর, বেশির ভাগই মৃত।


Admission granted; thus mission completed 
বিদায়ী সন্ধেটা কাটল ভারী আনন্দে কিন্তু। সকলে মিলে আড্ডায়-গানে তিনটি বাসের বিয়াল্লিশ জন কেমন করে যেন এক ছাতার তলায় চলে এলাম। অনেকের নানা বিশেষ গুণাবলী শেষ দিনে উন্মোচিত হলো। আরও সমৃদ্ধ হলাম আমরা, পারস্পরিক আলিঙ্গন ও মূল্যায়নে মানবিকতার উদারতম দিকটা উদ্ভাসিত হলো। অপেক্ষাকৃত রাশভারী ডঃ সুব্রত বক্সী তাঁর অবিস্মরণীয় ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা অতি সরসভাবে ব্যক্ত করলেন আর টিকা-টিপ্পনি সহযোগে ডঃ চৌধুরী তাতে আরো রসসঞ্চার করলেন স্বভাবসিদ্ধভাবেই। তৃপ্তি বৌদির গানে এই সামগ্রিক ট্যুর-এর তৃপ্তির নির্যাসটুকু নিয়ে সভা সাঙ্গ করে ফেরার প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করলাম। 


আজ যথাসময়ে প্লেন ছাড়ল - আন্দামান ও নিকোবরের দ্বীপগুলো বিন্দুর মতো ছোট হতে হতে ক্রমশঃ মিলিয়ে হারিয়ে গেল অসীমে - রেখে গেল আমাদের মনে সবুজদ্বীপের রং - সজীব, সতেজ। অত্যন্ত বর্ণময় বৈচিত্র্যের সাক্ষী রইলাম আমরা - মস্তিষ্কে জমা পড়ল প্রচুর মূল্যবান রসদ। আদিম উপজাতির স্বাধীনতা থেকে বন্দি ভারতবাসীর পরাধীন বিক্রম, মনোহর প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য থেকে সমুদ্রতলের অনন্ত বিস্ময় - এতো কিছুর অসামান্য মিশ্র উপাদান এই একটা সফরে।

শহর আন্দামান
সাত দিনের এই সফর মনের জানলায় অনায়াসে এঁকে দিতে পারে সবুজ রং - মস্তিষ্কের কোষে জমা হয় এক আকাশ স্বপ্ন ....... 

দেহের প্রতিটি স্নায়ু জীবন্ত হয়ে করে অঙ্গীকার 
আগামীকে ভালোবেসে স্বীকার করবার।

সেলাম আন্দামান !!!

- তপন বসু

শেষ .....


আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
©tapanbasu
photo courtesy : author 

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু