কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ৫ (১০ই জানুয়ারী ২০২১) | Kanchanjanghar Diary Ep#5
কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি-পর্ব ৫ (১০ই জানুয়ারী ২০২১ - রাত ১০টা)
'এবার আমার ঘরে ফেরার গান
পর্যটনের সুখের ছবি -
রেখায় আঁকুক বাউল কবি -
বেড়ানোর সুখ সাঙ্গ করে,
স্মৃতির পাতা বন্ধ করে ;
নিজের বাসায় ভালোবাসায়,
আপন আনন্দ-স্নান'।
এবারে আর ফ্লাইট লেট্ করে নি। তল্পিতল্পা নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম রাত ৮টা নাগাদ। বেড়ানোর আনন্দ আর ঘরে ফেরার আনন্দে একাকার হয়ে বেড়ানোর গল্প শুনতে অতি আগ্রহী মা'য়ের সঙ্গে বাহির-মহলের গল্পে মশগুল হলাম। সেই গল্প করতে করতেই লিখতে বসলাম আজকের ডায়েরি - আমাদের 'কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি'র ৫ম ও অন্তিম পর্ব।
জানুয়ারীর ৫-এ আমরা পৌঁছেছিলাম দার্জিলিং। সেখানে ঠিকই ছিল যদি weather ঠিক থাকে, তাহলে সকালের ব্রেকফাস্ট সেরেই ম্যালের উদ্দেশে রওনা দেব। কপাল এতো ভাল, যে তিনদিন দার্জিলিং-এ ছিলাম, বেশির ভাগ সময়টাই আকাশ ছিল পরিষ্কার। কাঞ্চনজঙ্ঘার গল্প ও ছবি তো আগেই শেয়ার করেছি। তাই আমরা পায়ে হেঁটে (যদিও ম্যাল-এ হন্টন ছাড়া গতি নেই) হোটেল থেকে ম্যালের পথ পাড়ি দিয়েছি দুটো দিনই। হাঁটাপথের বাঁহাতে ধাপে ধাপে রাস্তা নেমে তৈরী করেছে দার্জিলিং শহরের মানচিত্র, আর ডানহাতে দোকান ও হোটেলের সমন্বয়ে আলোর সম্ভার। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতেই গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম। অনভ্যাসের হাঁটা অনুভব করতাম না। এভাবে সুন্দর কাটল দার্জিলিঙের অবস্থানটুকু। আগের পর্বে সে কাহিনি শুনিয়েছি। এবার সেখান থেকে ৭ তারিখে চলে এলাম ঘুম-এর দেশে, দার্জিলিং-এর কাছেই আরেক হোটেল - স্টার্লিং রিসোর্টে, ঘুম রেল স্টেশনের একদম কাছেই।
৮ তারিখ সকালে একটা টাটা সুমো পেলাম sight seeing ট্যুরের জন্যে। কেভেন্টার্সের সামনেই একটা junction, সেখানেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। এখানে সারাদিন আপনি ভাড়ার গাড়ি পাবেন, যেখানে যেতে চান - খুব সঙ্গত মূল্যে যে কোনো ধরণের গাড়ি আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। গাড়ি এলো যথাসময়ে - টাটা সুমো। একটু আশাহত হলাম, কারণ আমরা Innova বুক করেছিলাম। এই বিষয়ে আরেকটু সতর্ক হবার দরকার ছিল, কিন্তু আমাদের নরমপন্থী মনোভাবই এই আশাভঙ্গের কারণ। প্রসঙ্গতঃ 'সামিট সুইস হোটেলে'র নিজস্ব কোন গাড়ি নেই, তাই বাইরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড-এর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। এই টাটা সুমোতেই দার্জিলিং থেকে ঘুম এবং ঘুম থেকে সাইট সিইং-এর উদ্দেশে সারাদিনের পরিভ্রমণ।
ব্রেকফাস্ট সারা হলো বাতাসিয়া লুপের কাছে একটা বাঙালি ধাবায়। গরম কচুরি/লুচি আলুর চচ্চড়ি গুছিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ১১টা নাগাদ। প্রায় ঘন্টাখানেক চলবার পর এসে পৌঁছলাম প্রথম দর্শনস্থানে -Takda Orchid Garden। গেট থেকে ঢুকলেই ডাইনে-বাঁয়ে চোখে পড়বে নানা জাতের অর্কিড। 'তিনচুলে' গ্রামের মধ্যে চোখ-জোড়ানো ল্যান্ডস্ক্যাপে ঘন সবুজের মধ্যে রঙিন অর্কিডের সংগ্রহ উল্লেখযোগ্য। যাদের একটু-আধটু গার্ডেনিং-এর শখ আছে, তাদের খুবই ভাল লাগবে এই রঙিন বৈচিত্র্যময় Orchid Garden। এরপর 'তিনচুলে' থেকে আরো প্রায় আধঘন্টা চলে আমাদের গাড়ি একটা পাহাড়ী বাঁকে এসে দাঁড়াল। দেখি, বাঁকের বাঁ দিক বরাবর একটা রাস্তা একটু সরু হয়ে মিশেছে বেশ খানিকটা নিচে ভ্যালি-র মতো জায়গায়। এখানকার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি এতো সজীব যে তার প্রেক্ষাপটে ভ্যালিটাকে ঠিক যেন একটা সবুজ রঙের কারুকার্যখচিত কাঁচের বাটির মনে হচ্ছে। ভ্যালি বা গ্রাম - যাই বলি না কেন, এর নামটি ভারি মিষ্টি - Chhota Mangwa। শুনেছি, চাঁদনী রাতে এই ভ্যালি-তে থাকতে পারাটা খুবই মনোরম অনুভূতি। এবারে আমাদের এখানে থাকার কোন প্ল্যান নেই। শুধু এটুকুই বলি, এই উপত্যকার বাঁ দিকে সিকিম পাহাড়, ডাইনে কালিম্পঙ পাহাড় আর দার্জিলিং তো রয়েছেই। এই তিন সুন্দরীর ঠিক মধ্যিখানে অবস্থান করছে Chhota Mangwa।
Orchid Garden |
হাতের কাছেই অগুণতি ছোট ছোট খাবারের দোকান। লুচি, পরোটা থেকে শুরু করে ভাত-ডাল-তরকারি পাওয়া যাচ্ছে। 'দাঁড়াও পথিকবর, তিষ্ঠ ক্ষণকাল' - খিদেও পেয়েছিল - দাঁড়িয়ে পড়লাম, বলা ভালো বসে পড়লাম এক নেপালি মালিকের বাঙালি খাবারের দোকানে। এও এক আবিষ্কার। নেপালির হাতে বাঙালির মাংস-ভাত। মাংস বলতে চিকেন - চিকেন কষা এল ভাতের সঙ্গে, অন্যান্য তরিতরকারির পার্শ-সহযোগিতায়। গরম গরম খেতে ভালোই লাগল, তবে চিকেনের পদ না কষা, না ঝাল, না ঝোল। দোকানের ঠিক উল্টোদিকে মমতা ব্যানার্জী'র নামে পার্ক তৈরী হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে খেয়ে নিলাম। অপরূপা প্রকৃতির সৌজন্যে স্বাদ রইল অধরা, খাবার নষ্ট হলো না।
আশেপাশে এর চেয়ে ভাল খাবারের রেস্তোরাঁ আর নেই, সুতরাং 'এহ গ্রাহ্য'। সেখান থেকে বেরিয়ে পার্ক-এর দিকে চেয়ে দেখলাম। পাহাড়ের গায়ে রাস্তা বানানো ছাড়া আর কিছুই করতে হয়েছে বলে মনে হলো না। সাজানো বাগানের সুন্দর মুখ থেকে গোঁফ ছেঁটে রাস্তা তৈরী করলে যেমন লাগে, ঠিক তাই হয়েছে এই পার্কের চেহারা। আর হ্যাঁ, এখানে ঢুকতে গেলে টিকিট লাগে, ভাবলেই কোথায় যেন ব্যাথা(?) লাগে ! নিজস্বতা হারিয়ে পরের হাতে বিকৃত ও বিক্রীত।
খেতে বসে ছোড়দি আর স্বপ্না, কুটু আর বুবলুর কাছে ওদের কলেজ আর হোষ্টেল লাইফের গল্প শুনতে চাইল। ওদিকে রান্না তৈরী হচ্ছে, এদিকে সময় কাটানো আর কি ! পার্কে যেতে ইচ্ছেই জাগল না। এর থেকেই বোঝা যেতে পারে পার্কটা কতো সুন্দর এখন হয়েছে, আর আরও কতো সুন্দর ছিল বা হতে পারতো ! Natural Beauty যে কোন মূল্যেই আকর্ষণের শীর্ষে থাকে, মানুষের দ্বারা একই সঙ্গে শৈল্পিক দৃষ্টি আর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে Natural Resourceকে আরো উন্নত করা খুব সহজ কাজ নয়, আর সেটা সবার পক্ষে করে দেখানোও সম্ভব নয়।
Mamata Park |
কুটু বুবলুর কথার রেশ টেনেই বলল, আমার স্কুলে কিছু বন্ধুরা ছিল, যারা পরে আমার সাথে একই কলেজে পড়েছে। তারা যে কি দুষ্ট আর কতটা বুদ্ধিমান হতে পারে, তা কল্পনাই করতে পারবে না। অদ্ভুত তাদের নাম, মানে সেটা স্কুলেই এর ওর ডাকে জনপ্রিয় হয়েছে। এক ছাত্র খুব জনপ্রিয় হয়েছে 'পাতা' নামে, আরেকজন 'নেংটু'। প্রথমজনের বইয়ের পাতার চেয়ে উদ্ভিদের বিচিত্র পাতায় প্রবল আগ্রহ আর দ্বিতীয় জনের মুখের ভাষা এতটাই লাগামহীন ও খোলামেলা যে তাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে বন্ধুরা নাম রেখেছিল 'নেংটু'। একজন শিক্ষকের মেয়ে নাকি তার চেয়ে তিন বছরের ছোট একজন বন্ধুর সঙ্গে ক্লাস করতে চেয়ে পরপর তিনবছর ফেল মেরেছিল। নেহাৎ ওই স্কুলেরই শিক্ষকের মেয়ে বলে তাকে আর বহিষ্কার করা হয় নি।
বুবলু যোগ দিল, ওর এক বন্ধু নাকি 'চোর' নামেই বিখ্যাত হয়ে উঠল IIT ক্যাম্পাস-এ। সে জন্ম-ইস্তক 'ক্লেপ্টোম্যানিয়াক', বাংলায় 'চৌর্যোন্মাদ'। তার চুরির তালিকায় 'নাম-গোত্র-মূল্যহীন', কারোর ছাড় নেই।
এদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য এবং এহেন দস্যি-দামালেরা পরবর্তীকালে প্রফেশনাল কর্মজীবনে ঠিক কতটা সফলতার শিখরে পৌঁছেছিল, সেই গল্প শুনতে শুনতেই নেপালি দোকানে বাঙালি খাবারের পাত পড়ল। খেতে খেতে কুটু-বুবলুর বলে যাওয়া আমাদের ছেলেদের গল্প-কথাগুলোই ভাবছিলাম। যে বন্ধুদের 'ডাক-নাম' নিয়ে এতো রসিকতা, তাদের ঘিরে এতটাই মজার জগৎ - অথচ এদের যোগ্যতার প্রতিও সমপরিমাণ সমীহ ও সম্ভ্রম সত্যিই তাৎপর্যের এবং সেখানেই এদের সকলের উত্তরণ। 'ডাক-নাম'-এর অংশীদার যেদিন 'নামডাকের' অধিকারী হন, তখন তাদের ছেলেবেলার ছেলেমানুষী মুহূর্তগুলো প্রবীণ বয়সের কাছে উত্তরণের উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাললাগাগুলো একটু একটু করে জড়ো হয়ে শ্লথ হয়ে যাওয়া মনের রথের চাকা আবার ছুটে চলবার অনুপ্রেরণা পায়। মাথা নামালাম খাবারের প্লেটে।
এবার আমাদের শেষ গন্তব্য - Orange Garden। এখানেও ঢুকতে গেলে টিকিট লাগে, বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। নিজের পয়সায় কেউ কিছু করবে না, কোন না কোন ভাবে অন্যের দৃষ্টিনন্দন কিছু বানিয়ে 'পরের ধনে পোদ্দারি'। এই বাগানে গাছের লেবু তোলা যাবে না। লেবুতলায় লেবু পড়ে থাকলে তা বিনি-পয়সায় দর্শনার্থীদের। আপনাকেই ঠিক করতে হবে গাছের উপরে তাকাবেন না নিচে লক্ষ্য রাখবেন। শাস্ত্র বলে,'নজর সর্বদা উঁচুতে রাখবে'। সত্যি, আশ্চর্য এক লেবুবাগান। লক্ষ লক্ষ লেবুর দিকে লক্ষ্য রাখতে রাখতে ছবি তুলছি। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, 'লেবু কিনবেন ? ১০ টাকায় একটা'। এই অবধি সমস্যার নয়। প্রণবদা ২০টা লেবুর একটা বস্তা বাগিয়ে ফেলল। বাচ্চাটা বলল,'ঘরে আরো আছে, ইয়া বড়ো বড়ো'- বলে বাগানের মধ্যে যে homestay রয়েছে, তার দোতলায় ইশারা করল। বাড়িটার তিনতলা নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, '১০টা আনো'। তারা এক একটি ১৫ টাকা। বিক্রেতা বললে,'এগুলো নাকি এক্সপোর্ট কোয়ালিটি'। এ দেশে ঘরের জিনিসের বাইরে কদর। আমরাও সেই মন্ত্রে বাইরেকে নিয়ে এসেছি বসবার ঘরে। আমাদের আদব-কায়দা-সংস্কৃতি বদলে ঘরে ঢুকছে পশ্চিমি হাওয়া। পূবের আলো ম্রিয়মান হয়না বলেই পশ্চিমের অন্ধকারেরা আমাদের অন্ধ করতে পারে না।
বিকেলের মধ্যেই ফিরে এলাম হোটেলে। পরের দিন অর্থাৎ ৭ তারিখে আমাদের এই হোটেল ছেড়ে এশিয়ার সর্বোচ্চ রেল স্টেশন-শহর ঘুম-এ যাবার কথা। এর আগে ঘুম থেকেই দার্জিলিঙে উঠেছি, তবে টানা তিন দিন ঘুমিয়ে থাকা I mean, 'ঘুমে' থাকা এই প্রথম। Bed Warmer টা চালিয়ে গেছিলাম, বিছানার উষ্ণ-আদরে সেই ঘুম-এর কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঘুমিয়েই পড়েছি। ঘুম ভাঙল পরদিন আবার ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার ডাকে - সে আবার মেলে ধরেছে নিজেকে। কি এক সম্মোহনী জাদু আছে ওই পাহাড়চূড়ায়। মাথার উপর ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ সাজিয়েছে জটার মতো। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যায় !
ঘুম-এ উঠেছিলাম স্টার্লিং রিসর্ট-এ। আমি এখানকার মেম্বার, ফলে বুকিং পেতে কোন অসুবিধে হয় নি। এখানের প্রপার্টিটা বেশ সুন্দর। ফিরে আসার আগের দিন আধঘন্টার দূরে আরেকবার দার্জিলিং-এর ম্যাল-এ ঘুরতে গেছিলাম। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা আর ১৬-আনা বাঙালি খাবার খেয়ে দিনটা কাটিয়েছি। তেমন বলবার মতো কিছু ঘটে নি। দার্জিলিং থেকে ঘুমের দূরত্ব মাত্র ৮-৯ কিমি, গাড়িতে আধঘন্টার পথ। ৫০০ টাকা ভাড়ায় যখন তখন ঘুম থেকে জাগরণের বুকে পৌঁছনো যায়।
মায়ের সাথে শেষ হলো গল্প-কথা, ছবি দেখানো। আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্তও শেষের পথে। কোলকাতায় বড্ড গরম। শীতের আদরে বিছানার চাদরে গুটিয়ে নিজেকে গরম রাখতে হয়েছে গতকাল পর্যন্ত। আজ নিজেকে মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে, আবরণ থেকে মুক্ত হতে ইচ্ছে করছে উষ্ণ আবহাওয়া আর চেনা গন্ডির পরিমণ্ডলে চেনা সুখ-দুঃখের আঙ্গিনায়।
"আমার এ ঘর বহু যতন করে -
ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে"।
একঘেঁয়েমির জীবনযাপনে কিছুদিন অন্তর লাগুক বাইরের হাওয়া, আসুক নতুনকে দেখার সুযোগ - প্রাণে উঠুক খুশির তুফান। কিন্তু সে সবই যে চিরন্তনের খোলস বদল। আমার ভিতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে যেখানে আছে সেই চেনা মুখেরা, চার দেওয়ালের মধ্যিখানে তৈরী হওয়া এক অন্য জীবন - সেটাই যে একান্তভাবে আমার, আমার একান্ত নিজস্ব।
- সমাপ্ত -
(c) tapan basu. all rights reserved
photo courtesy : author
"কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি" প্রথম পর্ব থেকে পড়তে ক্লিক করুন 👉 প্রথম পর্ব
Comments
Post a Comment