কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ১ (২রা জানুয়ারী ২০২১)

কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ১ (২রা জানুয়ারী ২০২১ - রাত ৮টা)

ইংরেজী'র ২০২০ সাল অবশেষে পার হল। তবে জানা নেই দুঃসময় পেরিয়ে এলাম কিনা। মন খারাপের বছর শেষে হঠাৎ একদিন বুবলু (আমার পুত্র) বললো - বাবা, দার্জিলিং যাবে ?

যেখানে রোজ বাজার যাব কিনা নিশ্চিত নই, সেখানে দার্জিলিং যাওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা বুঝে উঠতে না উঠতেই বুবলু আবারও বলল, 'কুটুদাদা 'ধরেছে দার্জিলিং বেড়াতে যাবে'। এরা এখন বড় হয়েছে, তাই 'বায়না ধরেছে' বলা গেল না। আসলে বুবলুও গত দু'বছর ধরে দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছে, নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয় নি। আমরা পরিবারের সকলেই আর পাঁচজনের মতো ঘর-বন্দি। তাই এই খাঁচা থেকে বেরোতে মন প্রবল উৎসাহ যোগাচ্ছে। কুটু হল আমার স্ত্রী স্বপ্নার দিদির ছেলে। তার আর বুবলুর প্রবল নেশা দেশভ্রমণে। এরাও গত ন'মাস নিজের কাজ ছেড়ে ঘরের কোনায় একটা টেবিল-চেয়ার-ল্যাপটপে আবদ্ধ। সুতরাং কারোরই 'হ্যাঁ' বলতে বেশি ভাবনা-চিন্তা করতে হল না। কুটুই সব আয়োজনের দায়িত্ব নিল। তারিখ ঠিক হল জানুয়ারী'র দুই - ঐদিন যাত্রা শুরু। প্যান্ডেমিক পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে আপাততঃ দুই পরিবারের ছয় জন মিলেই যাওয়া স্থির হল। ছয় জনের দল হলে একটা সুবিধে যে একটা Innova বা Scorpio গাড়িতেই একসাথে বেরিয়ে পড়া যায়। আমাদের ছ'জন অর্থাৎ আমরা তিনজন ও স্বপ্নার দিদিরা তিনজন। স্বপ্নার দিদি বলতে সম্পর্কে আমার শ্যালিকা সন্ধ্যা ও জামাইবাবু প্রণবেশ।

এয়ার-এশিয়া ফ্লাইটের টিকিট সস্তা পড়ল ইন্ডিগোর থেকে। সস্তার প্রথম অবস্থা টের পেলাম। ২রা জানুয়ারীর সকাল ন'টার ফ্লাইট বাতিল হয়ে দুপুর তিনটে হল। একদিকে অবশ্য মন্দ হল না। কারণ সকাল ন'টার ফ্লাইট ধরতে গেলে এয়ারপোর্ট পৌঁছতে হতো সাতটার মধ্যে। তার মানে....... ...... আর ভেবে কাজ নেই ! কলকাতায় ঠান্ডাটা বেশ জম্পেশ পড়েছে। ভোর পাঁচটায় উঠে রেডি হয়ে ......  ঈশ্বর যা করেন ........

আমরা এয়ারপোর্টে জমায়েত হলাম ঠিক দুপুর একটায়। সিকিউরিটি চেক করে ফুড কোর্টে হালকা টিফিন করে প্লেনে চেপে বসলাম আড়াইটেতে। প্লেনের জানলা দিয়ে ঝলমলে রোদ এসে গৃহবন্দী এই আমাদের সারা শরীরে নতুন বছরের নতুন আলো মাখিয়ে দিয়ে গেল। ফুরফুরে মন নিয়ে সিট-বেল্ট বেঁধে নিলাম। কলকাতা এয়ারপোর্টে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করলাম। অনেক বেশি ঝকঝকে, প্রচুর নতুন নতুন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের উপস্থিতিতে No-contact treatment..... স্বস্তি দিল অনেকটাই। 

পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাগডোগরা। গাড়ি ঠিক ছিল - ব্যবস্থাপনায় দুই ভাই কুটু ও বুবলু। একটু চা খেলাম এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে - খুব সুন্দর চা, কুড়ি টাকায় প্রতি ভাঁড়। ইনোভা গাড়িটা প্রায় নতুনই বলা চলে। ড্রাইভার স্থানীয়, নাম সুমিত - নাম বাঙালির মতো, নাক চ্যাপ্টা। করিতকর্মা সুমিত সমস্ত লাগেজ গাড়ির মাথার ওপর বেঁধে ফেলল তৎপরতার সঙ্গে। সেই দেখে প্রণবদা বলল, 'এদের হাইট কম, কিন্তু কি চটপটে' ! হাইটের সঙ্গে চটপটে হবার কি সম্পর্ক সেই নিয়ে কেউ অতিরিক্ত মাথা ঘামালাম না।  কারণ ঠান্ডা মোটামুটি যা আঁচ করলাম, তাতে সহজে মাথা ঘামবে না।  

দেড় ঘন্টায় পৌঁছলাম কার্সিয়ং - আমাদের প্রথম গন্তব্য। বলে রাখা ভাল, এবারে আমরা একটু ছুটি কাটানোর মতলবেই বেরিয়েছি। খুব এদিকে-সেদিকে ঘুরব এমন প্ল্যান কিছু নেই। কুটু বুক করেছে যে হোটেল, গেট দিয়ে ঢুকতে তার নাম দেখলাম Cochrane Place। আমাদের ট্যুর প্ল্যান সম্পর্কে বুবলুকে একদিন জিজ্ঞেস করতে ও বলেছিল, তোমার এতো কিছু জানবার দরকার নেই। কুটুদাদা ভালো হোটেলই বুক করেছে। যেখানে আমরা নিয়ে যাবো, সেখানেই তোমরা যাবে - খারাপ লাগবে না। এই যে চাপহীন ভ্রমণ - এ আমার জীবনে চাকরি পাবার পর প্রথম। নাহ ! মনে হচ্ছে দু'হাজারএকুশটা ভালোই যাবে। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে কি অভূতপূর্ব আনন্দ অনুভব করলাম বলে বোঝাতে পারব না। সেই কোন ছেলেমানুষ বয়সে বেড়াতে যেতাম বাবার হাত ধরে - সেদিনও কোন চাপ থাকতো না। শুধু এটুকুই বুঝতাম, বাবা নামের এই মানুষটা আমাকে, আমার মাকে, বোনকে আনন্দ দিতে কতটা বদ্ধপরিকর। আজ তেমন করেই আপ্লুত হলাম ছেলেদের কল্যাণে। 

হোটেলের গেট দিয়ে ঢুকেই বড় একটা চাতালের মত লন - চারিদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। কুটু বলল, তোমরা কেউ নামবে না। আমি নেমে দেখছি ঠান্ডা কেমন। সেই অনুযায়ী হাতব্যাগ থেকে গরম জামা পরে তারপর নামবে। তিনজন বেলবয় এগিয়ে এলো গাড়ির মধ্যে সমস্ত কিছু স্যানিটাইজ করতে। করোনা বা কোবিদ কিছু ভাল অভ্যাস উপহার দিয়েছে আমাদের। দুই ভাই কুটু আর বুবলু আমাদের চার জনের জন্যে একটা রুম বুক করেছে - সেটা নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে একটা উত্তেজনা লক্ষ করেছি গাড়ি থেকে নামার পরপর। ঘরে ঢুকে তার কারণ বুঝলাম - ডুপ্লে টাইপ সুপার ডিলাক্স রুম - দরজা পেরিয়েই মস্ত হল, তার একদিকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে আরেকটি ডাবল-বেড রুমের দিকে। হলঘরের সামনে দিয়ে আরেকটু এগোলেই মাস্টার বেডরুম। প্রায় চারশো স্কোয়ার-ফুটের ঘর - সেখানে মেহগুনি কাঠের বিছানা, আলনা, আলমারি ও বুকশেলফ। বুকশেলফে দেশি-বিদেশী বইয়ের সম্ভার। লাগোয়া টয়লেট - যেটি আধুনিক সরঞ্জামে পরিপূর্ণ এবং বলাই বাহুল্য, এটিও আয়তনে প্রায় দুশো স্কোয়ার-ফুট। ঘরের দুই দিক খোলা - কাঁচের জানলা দিয়ে অন্ধকারে বুঝলাম ওদিকটাতে ভ্যালি হবে বোধ হয়। 

কাল সকালে দিনের আলোয় ভালো করে দেখতে হবে - এই ভাবতে ভাবতে আজ লেখা শেষ করলাম। রাত ন'টা বাজে। ডিনার রুমেই দিয়ে গেল। বেড়াতে এসে ডায়েরি লেখাটা আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা। এবারের ডায়েরির নাম দিলাম "কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি"। আশ্চর্য ! আমাদের সুইট'টার নামও 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'। 

আগামীকাল আবার পরের দিনের গল্প। 
(c) tapanbasu. all rights reserved.
photo courtesy : tapan basu & aritra basu

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু