কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ২ (৩রা জানুয়ারী ২০২১ - রাত ৯টা)
কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ২ (৩রা জানুয়ারী ২০২১ - রাত ৯টা)
আজ সকালে ঘুমটা আচমকা ভাঙলো মৃদু কোলাহলের শব্দে। স্বপ্না মুখরিত হোটেল-ঘরের জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখতে পেয়ে। ডুপ্লে টাইপের সুইটে ওপরের ঘরে শুয়েছিলাম আমি আর প্রণবদা । প্রণবদা দেখি জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরের আকাশে ভাবুক চিবুকে স্থির রয়েছে। আমিও সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
হোটেলের এই ঘরের বারান্দার সামনে দিয়ে চোখের দৃষ্টি সবুজ এক ভ্যালি পার করে নিয়ে যেতে হবে সামনের পাহাড়ে। ঠিক যার মাথার ওপর দিয়ে আরো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা - বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আকাশ পরিষ্কার নীল, বনরাজি সবুজে সবুজ।
ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে সাতটা বাজে। চায়ের কাপ নিয়ে ঘরের সোফা আর বিছানায় আমরা সবাই লেপের মধ্যে পা ডুবিয়ে আয়েস করে বসলাম - কাঁচের জানলা দিয়ে চোখ খোলা আকাশপথে, যেখানে প্রায় একশো আশি ডিগ্রি জুড়ে সবুজ উপত্যকা, ব্যাকড্রপে হিমালয়ের ভুবন-ভোলানো ল্যান্ডস্কেপ।
আমাদের এই হোটেলটা ইন্টারনেট দেখে দেখে কুটু আর বুবলু পরামর্শ করে বুক করেছে। ব্রিটিশ ভদ্রলোক Mr Cochrane এই হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজ থেকে বহু আগে। তাঁর ব্যবহৃত হলুদ রঙের Volkswagen Beetle গাড়ি আজও আপনাকে স্বাগত জানাবে হোটেলের মেইন গেটে। যদিও এই হোটেলের মালিকানা আরো দু'বার বদল হয়ে এখন Mr. Aurora'র সম্পত্তি। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে তিস্তা পেরিয়ে পাঙ্খাবাড়ি রোডের ওপরেই এই হোটেল, জনবহুল কার্শিয়ং শহরের বাজার এলাকা থেকে আন্দাজ তিন কিলোমিটার আগে।
উৎসাহে ছ'জনেই টগবগে - শুধু এর মধ্যে কুটু বলল, 'কাল রাতে খেলা দেখতে দেখতে ঘুমটা ভাল হয় নি। তোমরা এগিয়ে পড়ো, আমি একটু বাদে তোমাদের ধরে নেব'। আমরা কেউ বুঝিনি যে কুটুকে অনেক আগে থেকেই নিচে নেমে আমাদের ধরবার দরকার ছিল। কারণ নামার সময় পাহাড়ি-পথে গড়িয়ে দিলেও আপনি কোথাও একটা নামবেন, হয়তো থামবেনও - কিন্তু ওঠবার সময়ে হাঁটুর জং-ধরা মালাইচাকি যেভাবে ব্যথা ও মর্মর শব্দ উত্থাপন করবে, যেমন আমাদের করতে শুরু করল, তাতে মাকাইবাড়ি চা-বাগানের প্রবেশ-দরজায় হাঁটু মুড়ে বসে পড়া ছাড়া ওই মুহূর্তে অন্য কোন বিকল্প মাথায় এলো না। ফিরতি পথে কেউ যদি উদ্ধার করে তো ভাল, নইলে কুটু হোটেলে আছে, সে বুঝে নেবে। একা নিশ্চই বাকি ট্যুর করতে চাইবে না। এইসঙ্গে এটাও বুঝলাম, কুটু কতটা দূরদর্শী !
সেই মুহূর্তে আমাদের আর উপরে ওঠার কোন উপায় দেখলাম না। কিছুক্ষণের জন্যে অন্তত সে পথ বন্ধ হয়েছে বলেই অনুমান হলো। এদিকে উপরের রাস্তায় চেয়ে দেখি একটা সবুজ রঙের মারুতি ভ্যান ব্যাকগিয়ারে আমাদের দিকে আসছে, তার মুখ পাহাড়ের চূড়ার দিকে। অনেকটা লোকাল ট্রেনের মতো, হঠাৎ স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন কোন দিকে যাবে ভাবতে ভাবতেই সে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দৌড়তে থাকে। ভাবলাম, ঈশ্বর নিশ্চই সহায় হয়েছেন। এই গাড়ি উপরে যেতে গিয়ে আমাদের অবস্থান লক্ষ্য করেছে, তাই ফিরে আসছে এই অসহায় পঞ্চ-রত্নকে উর্দ্ধমুখে নিয়ে যাবে বলে।
হায় রে ! কি কান্ড ! কাছে এলে বোঝা গেল, ওর গাড়ির ফার্স্ট গিয়ার্ কাজ করছে না - ফলে তারও আর উপরে ওঠার সম্ভাবনা নেই, তাকে ব্যাকগিয়ার দিয়ে কত নিচে নামতে হবে, সে কথা ভেবেই শিউরে উঠলাম। কোন গাড়ি ব্যাকগিয়ার দিয়ে পিছনমুখী হয়ে পাহাড়ে চড়ছে, এমন দৃশ্য আমি কল্পনাতেও আনতে পারলাম না।
প্রায় আরো চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করবার পর একটা খালি গাড়িকে হাত দেখিয়ে আমাদের হাঁটুর দুর্ভাগ্যের কথা জানালাম, পাহাড়ি ড্রাইভার সহৃদয়ে আমাদের উত্তরণের পথ দেখাল, বিনিময়ে আড়াইশো টাকা ভাড়া নিল। ওই অবস্থায় ওই ভাড়া দিতে গায়েই লাগল না। আমি অনেক অভিজ্ঞতায় এটা বুঝেছি, আসলে টাকার গায়ে যে দাম লেখা থাকে, তা সত্যি নয়। পরিস্থিতির বিচারে তার মূল্য এক একরকম। যেমন এক্ষেত্রে - মনে হলো এক কাপ চাও এর চেয়ে দামি। চা বাগিচার আশেপাশে ফোনের নেটওয়ার্ক শূন্য, তাই হোটেলে ফোন করে কোন গাড়ি আনিয়ে নেওয়ারও উপায় ছিল না। সেইহেতু গাড়ি যেই পেলাম, অমনি কার্শিয়ং রেল স্টেশনের কাছটা ঘুরে আসবার প্রবল বাসনা দেখা দিলো। বাঙালি খেতে পেলেই শুতে চায়, অহেতুক এই প্রবাদকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে কোনরূপ ইচ্ছে জাগলো না।
গলা শুকিয়ে জলের প্রতীক্ষায় - এমন সময়ে চোখে পড়ল দার্জিলিঙের বিখ্যাত কমলা লেবু, একশ-আশি টাকায় বারোটা। চিনির মতো মিষ্টি লেবুর কোয়া মুখে নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। এই জায়গাটা সমতল, হোটেলে ফিরতে নামতে হবে - তাই ভয় কম, গাড়ি না পেলেও গড়িয়ে যাওয়া যাবে। আমাদের হোটেল পাঙ্খাবাড়ি রোডের উপর। কার্শিয়ং রেল স্টেশনটা পাঙ্খাবাড়ি রোড আর হিলকার্ট রোডের সংযোগস্থলে। বাঁদিকে টয় ট্রেনের লাইন ধরে দুপাশে বাজার। ডানদিকে রেল স্টেশন - এখন শুনসান ফাঁকা। ট্রেনের ইঞ্জিন কারশেডে ন'মাস ধরে দাঁড়িয়ে থেকে তারও হাঁটুর অবস্থা আমাদেরই মতো, সে যে আবার নড়বে চড়বে - এমন ভরসা পাওয়া গেল না।
অল্প কিছু খোলা হাওয়া খেয়ে হোটেলে ফিরলাম, যেহেতু বাজার এলাকা - গাড়ি পেতে অসুবিধে হলো না। মাথাপিছু কুড়ি টাকায় কমলার স্বাদ মুখে নিয়ে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে তিনটে বাজে। সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে, তাকেও দেখতে এক্কেবারে কমলালেবুর মতো - নীল-সবুজের মধ্যিখানে সে গেরুয়া পরেছে, চোখ ফেরানো দায়। সাড়ে চারটে থেকেই কার্শিয়ং-এ সন্ধ্যা নামতে শুরু করে, সঙ্গে তাপমাত্রার পারদ। দিনের বেলায় আজ এগারো ডিগ্রির উপর ওঠে নি - কাল রাতে ছিল ছয় থেকে আটের মধ্যে। দুপুরে বেশ জম্পেশ খাওয়া হলো। এই হোটেলের রান্নার মান অত্যন্ত ভাল, পরিমাণ যথাযথ, দাম ঠিকঠাক। আজ তো বেশ ভীড় রয়েছে ডাইনিং রুম-এ, রবিবার বলেই হয়তো ! কুটু খাবার টেবিলে যথেষ্ট সংযত, খেতে ভালবাসে, কিন্তু খাবার নষ্ট করতে একদম নয়। বুবলুর আবার জীবনের লোভনীয় এক্সপেরিমেন্টগুলো খাবারের টেবিলে করতেই অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে অর্ডার বনাম এক্সপেরিমেন্টের দ্বৈরথ অনিবার্য। প্রণবদা খুব কম কথা বলে, তাই স্বভাবতই দায়িত্ব আমার অনেক বেশি - দু'জনের কথা আমাকে বলতে হয় - এই ট্যুরে আপাততঃ এইটাই আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মধ্যস্থতার দায়িত্ব নিলাম, কথা দিলাম খাবার নষ্ট হবে না। খুব সহজ পন্থা, নিজের খাবারটা কম অর্ডার করলাম - এমপেরিমেন্টে উদ্বৃত্ত হলে আমি আছি, নইলে একটু ছোট্ট অর্ডার। দুই ছেলেই সন্তুষ্ট।
বিকেলের দিকে একটু চোখ লেগে গেছিল বিছানায় - বড়জোর মিনিট পনের। চোখ মেলতে দেখলাম সবাই জেগে গল্পে মশগুল। ঘরে রাখা দার্জিলিং চা সহযোগে যোগ দিলাম আমিও। আজ সন্ধ্যের আলোচনার বিষয়বস্তু - হোমিওপ্যাথি বনাম এলোপ্যাথি। সামান্য সর্দিতে একমাত্র আমারই নাক বন্ধ, বাতাস মুখ দিয়েই অবলীলায় যাতায়াত করছে। অন্য কারোর কোন শরীর খারাপের লক্ষণ নেই। তবু ডাক্তারি শাস্ত্রের প্রসঙ্গ কেন উঠল, তা ঠাহর করতে পারলাম না। যেহেতু বিষয়বস্তু মাঠে নেমে পড়েছে, সেখানে খেলায় যোগ দেওয়া ছাড়া উপায়ও কিছু নেই। আমি Toss করলাম, বললাম রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারিও করতেন। তাঁর ওষুধে মধ্যবিত্তের শরীর খারাপ থেকে ভালো হয়েছে, এই কথা সবিনয়ে জানিয়ে রাখলাম। ব্যাস, আমাকে আর বেশি কিছু বলতে হলো না, রবিবারের সন্ধ্যে রবিঠাকুরের ডাক্তারি থেকে বঙ্কিমচন্দ্র- রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার হয়ে বর্তমান কোবিদ ভাইরাস ভ্যাকসিন-এ এসে থামল। পুরো নব্বই মিনিট, বিরতি ছাড়া। আমরা অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের কাছ থেকে জানলাম, ভ্যাকসিন বেরোলেই তাকে আমাদের শরীরে স্থান দিতে হবে যথেষ্ট সম্ভ্রম ও তৎপরতার সঙ্গে, তদুপরি আমাদের বাকি চারজনের এই বয়সে বাড়িতে হোমিওপ্যাথির কোন ওষুধ রাখা চলবে না - মান্ধাত্বা আমলের হ্যানিম্যানকে এখন নাকি নো-ম্যান'স ল্যান্ডে রাখাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি তো শুধু এটুকু বুঝি, ষাটের ওপর যে কোন কারোরই হোমিওপ্যাথি বা এলোপ্যাথি নয়, সিমপ্যাথিটাই বেশি কাম্য।
কার্শিয়ং-এর পাহাড়ে এসে চিকিৎসার এই চমৎকার আধুনিকতার বোধোদয়ে আমাদের বসু ও চক্রবর্তী পদবীর মাঝে বিশ্বাস এসে সমঝোতা করল। আমরা ডিনার সেরে শুতে গেলাম যে যার ঘরে।
রাত এখন ন'টা। রইলো আমাদের দ্বিতীয় দিনের দার্জিলিং ভ্রমণ কাহিনী। কালকের কথা কাল শোনাবো।
শুভরাত্রি .......
(c) tapanbasu. all rights reserved.
photo courtesy : tapan basu & aritra basu
Comments
Post a Comment