কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ৩ (৪ঠা জানুয়ারী ২০২১

কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ৩ (৪ঠা জানুয়ারী ২০২১ - সন্ধে ৬টা)


আজ সারাটা দিন দুরন্ত কাটল। ঘুম থেকে উঠেই তো চোখ গেল পাহাড়ের দিকে, সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান নয়। স্বপ্না একটু বিমর্ষ হয়ে মন্তব্য করল, 'ঐটুকু সাদা মেঘের কি ক্ষমতা ! এতো বড়ো 
কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকে দিল'। এও এক অপূর্ব খেলা প্রকৃতির - যদি না জানা থাকত যে, কাঞ্চনজঙ্ঘা ওখানে দেখা যায়, তাহলে ওই নীল গালিচায় সাদা মেঘটাকেই অপরূপ মনে হতো। যত রাগ গিয়ে পড়লো ওই মেঘের উপর। যতটা না আমার জন্যে, তার চেয়ে অনেক  বেশি স্বপ্নার ম্লান মুখটা দেখে। 
আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, পাহাড় না সমুদ্র - কোনটা ভাল লাগে ? মনে যা আসে তাই উত্তর দিয়ে দিই। আসলে কোন সময় যে কাকে ভালো লাগবে, তা আমার তো জানা নেই।  এবারে যেমন প্রতিটি মুভমেন্টই ভাল লাগছে। তা যে অনেকটা কোবিদের বিষদৃষ্টিতে বন্দিদশার কারণে তা বুঝলেও, এই শীতের পাহাড়কে বড়ো আপনজন মনে হচ্ছে।

চায়ের টেবিলে ঠিক হলো আমরা আজ একটা গাড়ি নিয়ে সাইট-সিইং-এ বেরুবো। কাল যা অভিজ্ঞতা, তাতে পদব্রজে বেশিদূর যাবার মোহ আর আমাদের কারোর মধ্যেই নেই। শুধুমাত্র কুটুই এতটা যোগ্য ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে যে, ও এর মধ্যে তিনবার ইউরোপ ঘুরে এসেছে এবং সেখানে পায়ে পায়ে প্রতিদিন আট থেকে দশ কিলোমিটার হেঁটে - পিঠে একটা সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের ব্যাকপ্যাক নিয়ে। ওর শক্ত-পোক্ত দু'পায়ে প্রণাম করতে মনে মনে সাধ জাগল। বুবলুও এই হেঁটে দেশভ্রমণে পক্ষপাতী, তবে ওর মাথার মধ্যে মিউজিকের নোটসগুলো 
সর্বদা এতো দ্রুতগতিতে ঘুরে বেড়ায় যে, ওর হাঁটবার গতি একটু কম। 

Cochrane হোটেলেই গাড়ি পেয়ে গেলাম, ঝকঝকে প্রায় নতুন  Xylo - ছ'জন আরামে সেঁটে গেলাম। কার্সিয়ং শহর থেকে পাঙ্খাবাড়ি রোড হয়ে দার্জিলিঙের পথে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার যাবার পর একটা রাস্তা ডান হাতে হঠাৎ বাঁক নিয়েছে। আমাদের গাড়ি সেই পথে পা রাখতেই মনে হলো এ এক অন্য পরিবেশে ঢুকলাম। আরো পাঁচশো মিটার যাবার পর চারিদিকে শুধু পাইন গাছ আর পাইন গাছ - হালকা মৃদুমন্দ হাওয়া ওই পাইন গাছের পাতায় দোল দিচ্ছে, একটা মিষ্টি সুর ওই নিস্তব্ধতাকে আরো প্রকট করে তুলছে। সূর্যের আলো বেশ জোরালো, তবু ওই ঘন পাইনের জঙ্গলকে ভেদ করবার শক্তি তার নেই। মাঝে মধ্যে ফাঁক-ফোকর দিয়ে আলো এসে পড়ছে রাস্তার উপর, সেখানে সাদায়-কালোয় বিধাতার আঁকা আল্পনা। চারিদিকে কোন জনবসতি নেই - রাস্তা তার নিজের মতো পথ করে এগিয়ে চলেছে আরো, আরো উপরের দিকে। আর আমরা চলমান গাড়ির মধ্যে বসে প্রকৃতির এই নির্মল সৌন্দর্যে নিজেদের সঁপে দিতে পেরে ধন্য মনে করছি। 


ড্রাইভার বলল, 'এই পাইন গাছ এক একটা দু'শো-আড়াইশো ফুট লম্বা হয়। এই পাইন গাছগুলোর বেশির ভাগ জাপানের একটা জাতের, যারা অত্যন্ত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। এই বিশাল এলাকা জুড়ে পাইনের বন এভাবেই বেড়ে উঠেছে, ঘন হয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে ড্রাইভার একটা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করালো। এখান থেকে রাস্তাটা প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে বাঁ-হাত বরাবর চা-বাগানের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। গাড়ি থেকে প্রণবদাকে লাফ দিয়ে নামতে দেখে ছোড়দি প্রায় আঁতকে ওঠে আর কি। সুন্দরের কোলে আত্ম-সমর্পণ বুঝে ছোড়দি আর মুখে কিছু বলে নি। সমুদ্রতল থেকে কার্সিয়ং রেল স্টেশন ৪৮৬৪ ফুট উঁচুতে। এই অঞ্চলটা আরো অন্ততঃ হাজার ফুট উপরে হতে পারে, যেখান থেকে 
কার্সিয়ং শহরটাকেও ছবির মতো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একটা প্যানোরামিক ভিউতে। 

পাইনের বন ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু মিউজিয়ামের দিকে। পথে এক জায়গায় একটা ভিউ-পয়েন্টে আমরা দাঁড়ালাম, যেখান থেকে অনেকটা দূর অবধি চা বাগান দেখতে পাওয়া যায়। রাস্তার বাঁদিক দিয়ে পাহাড়ের খাদ নেমে গেছে অনেক নিচে, যেখানে সবুজ উপত্যকার চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি জনবসতি। ড্রাইভার বলছিল, 'প্রশাসন এখানে প্যারাগ্লাইডিং-এর ভাবনা-চিন্তা করছে। সামনে অনেকটা পথ একদম ফাঁকা, গাছপালা বা অন্য কোন বাধা নেই'। আমাদের একটু চা তেষ্টা পেয়েছিল, ড্রাইভার তা আঁচ করেই নিয়ে এল Nirvana Retreat বলে একটা বুটিক চা-এর দোকানে। ডানদিকে পাইনের কোল ঘেঁষে একটা ছোট রিসর্ট। যার একপাশে খোলা আকাশের নিচে নানা ফুলের সমাহারে ঘিরে থাকা চায়ের দোকান। দোকান না বলে একে পার্লার বললে সঠিক হয়। কি চা নেই সেখানে ? rose tea, orange tea,divine tea - সে যে কতরকমের বৈচিত্র্য ! আমরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা চায়ের অর্ডার দিলাম, সব রকমের স্বাদ গ্রহণের অছিলায়। সঙ্গে হালকা স্ন্যাক্স - চিকেন পকোড়া, সুস্বাদু Cookies সহযোগে ওই স্বাদের চা ওই পরিবেশে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। 



ওখান থেকে মিনিট পনেরোর ড্রাইভেই পৌঁছে গেলাম নেতাজি সুভাষ মিউজিয়ামে। দুর্লভ ছবি অজস্র, সঙ্গে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখতে দেখতে মন পিছিয়ে গেল অনেকটা। এই বাড়িটা ১৯২২-এ কিনেছিলেন শরৎ চন্দ্র বসু, সুভাষ বোসের দাদা। নিজেরা বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটানো ছাড়াও এই দুই ভাই এই বাড়িতেই  ব্রিটিশ প্রশাসনের নজরবন্দি ছিলেন কয়েক বছর। বেশ কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি রয়েছে এখানে। সুভাষ বসু লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে, "বঙ্কিমবাবুর 'বন্দে মাতরম' নিয়ে দেশে তো তুমুল সমালোচনার ঝড় বইছে। এই বিষয়ে আপনাকে অনুরোধ জানাই আপনার মতামত প্রকাশ করবার জন্যে। এই পরিস্থিতিতে আপনার মূল্যবান মতামত দেশের কল্যাণের কারণে খুব প্রয়োজন"। এমিলিকে লেখা সুভাষচন্দ্রের খুব অন্তরঙ্গ চিঠিও রয়েছে এখানে। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে এই মিউজিয়াম ঘুরে দেখলে বেশ ভালো লাগবে। 
দুপুরের খাবারের কথা প্রায় ভুলতে বসেছি। সাড়ে তিনটের সময়ে ফিরলাম হোটেলে। লাঞ্চ সেরে একটু নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে লিখলাম আজকের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। কাল আমাদের দার্জিলিং যাওয়া। ওখানে পৌঁছে ডায়েরির বাকি পর্ব লিখব। আজ এই পর্যন্ত। 

(c) tapan basu. all rights reserved
photo courtesy : author

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু