কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ৪ (৬ই জানুয়ারী ২০২১ - রাত ১০টা)

 কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরি - পর্ব ৪ (৬ই জানুয়ারী ২০২১ - রাত ১০টা)


কাল এসে পৌঁছেছি দার্জিলিং - বাংলার রূপসী কন্যার কাছে। এই North Bengal বরাবরই আমার বড্ড প্রিয়। শিলিগুড়িতে একবার পৌঁছতে পারলেই মন আশ্রয় পায় প্রকৃতির নিবিড় অন্তরঙ্গতায়। চোখ যেদিকে যায়, দুই পা যেন সেদিকেই এগোতে চায় - এক হবার মন্ত্রে। সেবক রোড, হিলকার্ট রোড - এই দুই মূল রাস্তা শিলিগুড়ি থেকে আপনাকে নিয়ে যাবে সেখানেই - যেখানে আপনি যেতে চান। আর হ্যাঁ, যদি নিশ্চিত না থাকেন কোথায় যাবেন - তাহলে এই উত্তরবঙ্গ সফরে আপনার মন বুঝিয়ে দেবে 'দোটানা' কাকে বলে ! 'পাহাড়' যে এতো জীবন্ত, এতো রূপবতী হতে পারে, তা এ পথে 'পা' রাখলে তবেই 'হাড়ে হাড়ে' বুঝতে পারা যাবে। 

আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল যে এবারের পর্যটন একটু অন্যরকম হোক। যেখানে লট-বহর নিয়ে শুধু চরকিপাক নয়, শীতের পাহাড়ের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় জমে গিয়ে পাহাড়ী সৌন্দর্যকে জমিয়ে আস্বাদন করাটাই ছিল প্রকৃত অভিলাষ। এই ঘরবন্দি পরিবেশ বিশ্বের দরবারে তো কারোর স্বেচ্ছায় এসে উপস্থিত হয় নি ? তবু ঘরের বাইরে বেরোতে পেরেছি ভেবে যথেচ্ছাচারিতায় এই পাহাড়-পর্যটন উদযাপন করাটাও অনুচিত। যে কারণে আমরা শুরু করেছিলাম কার্সিয়ং দিয়ে, যেখানে তিন রাত্তির বলা যায়, প্রকৃতির কোলে বসে এক রকম আয়েশই করেছি। সেখান থেকে এবার দার্জিলিং, আমাদের ভ্রমণসূচীর মধ্যমণি।

কার্সিয়ং থেকে দার্জিলিং এসে উঠেছি Summit Swiss Hotel-এ। এই হোটেলটা দার্জিলিং মল থেকে ৯০০ মিটার দূরত্বে। যে রাস্তাটা কেভেন্টার্স-এর সামনে দিয়ে সমান্তরাল পথ এঁকেছে মল রোডের ঠিক উল্টোদিকে - যে রাস্তাটার বাঁদিক বরাবর Ramada থেকে শুরু করে আরও অনেক উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হোটেলের সারি, রকমারি দোকানপাটের প্রদর্শণী পাহাড়ের গা বরাবর - তারই মধ্যবর্তিনী এই হোটেল, রাস্তার ডান হাতে। বেশ বড় আকারের রিসেপশন পেরিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে বেশ কিছুটা নিচে পর্যন্ত। রিসেপশন অফিসিয়াল বললেন, 'আপনাদের ঘরটা একটু নিচের দিকে'। উঁচু পাহাড়-চূড়া দেখতে এসে নিচে নামতে মন চায় না। তবু এগোলাম - বলা ভাল নিম্নগামী হলাম। পাক্কা দুটি Floor নামার পর সাহায্যকারী ছেলেটি জানালে, 'এই আপনাদের ঘর'। ইচ্ছে হলো না ঘরের দিকে তাকাতে; কারণ তখন সূর্য সবে মাথার ওপর উঠে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য প্রাণীকুলের চোখে উন্মোচন করছেন। চোখ পড়েছে সেদিকে। সে পাত্রে দৃষ্টি পড়লে অন্য পাত্র যে নিতান্তই অরুচির !

কাঞ্চনজঙ্ঘার সম্পূর্ণ রেঞ্জ মধ্যদিনের আলোয় দিনের আলোর মতন পরিষ্কার - শায়িত বুদ্ধের শান্তির প্রতিচ্ছবি। রুপোলি মুকুট ঝলমল করছে তরাইয়ের সবুজ মখমলের বিছানো চাদরে। হোটেলে আমাদের ঘরের সামনেই মস্ত লন - সেখানে সোফা, চেয়ার ইতস্তত রাখা রয়েছে শরীরটাকে মেলে দেওয়ার জন্য। রইল পড়ে আমাদের লাগেজ ঘরের সামনের করিডোরে। আমরা শরীর মেলে দিলাম আরামকেদারায়, আর সঙ্গে থাকা মোবাইল ক্যামেরায় যে যার মত ধরে রাখলাম মন কেড়ে নেওয়া আকাশের নীলে মেলে ধরা সম্পূর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপোলি স্বপ্নকে। 

স্বপ্নই বটে ! এই আছি এই নেই ! কোথা থেকে হঠাৎ একরাশ সাদা মেঘ লেপের মতো ঢেকে দিল সমস্ত পাহাড়চূড়াকে - সূর্যেরও সাধ্যি কই তাকে ভেদ করে আলোকিত করে সেই চূড়ামণিকে ? আমি ভাবি ছোটবেলায় পড়া সেই দ্বন্দ্ববাদের ছড়া - 
'পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি ; 
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী'। 
এই পৃথিবীকে পরিচালনার আসল চাবি কার হাতে ? ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে পারে বলেই তো মানুষ প্রাণীকুলের সর্বোত্তম। আমিও সে কথাই ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকলাম, "সূর্যের তেজ থেকে কত সহজে মেঘের প্রলেপে আশ্রিত হতে পারে সচল ও অচল জগৎ"। 

এখন সূর্য ক্রমশঃ ম্রিয়মান। ঠান্ডার প্রকোপ হঠাৎ উর্দ্ধমুখী। হাওয়া লাগছে মাথায়, কানের পর্দায় - নিজেকে ঢাকতে ঘরে চলে এলাম। সেখানে কৃত্রিম উত্তাপ বাড়ানোর যন্ত্র। ঘরে ও বাইরে তাপমাত্রা ভিন্ন। বাইরে এখন ১১ ডিগ্রি, ঘরে ২৬। 

বুবলু বিছানার লেপে পা গুঁজে দিয়ে বলল, 'কাল চলো পায়ে হেঁটে দার্জিলিং ম্যালের আশপাশটা ঘুরে নিই আমরা। যারা যারা interested, তারা আমার আর কুটুদাদার সঙ্গে Keventers ও Glenary's - এ খেয়ে নেবে'। অর্থাৎ ওদের খাদ্যের ঠিকানায় কোন সংশয় নেই। সেই আবার পদযুগলের পরীক্ষার পালা, সে পরীক্ষায় পাশ হলেই Keventers বা Glenary's। আমি খেয়াল করেছি, কুটু বা বুবলু - যে যাই প্রস্তাব করুক না কেন, তার জবাবের ঠিকা বুঝি আমিই নিয়ে রেখেছি। বাস্তবে, প্রণবদা বা ছোড়দি (সন্ধ্যা) খুব কম মতামত দেবার মানুষ। কিছুতেই এদের 'না' নেই। তবে সবেতে যে 'হ্যাঁ' আছেই, তাও তো জোর গলায় বলতে পারি না। তাই সবার মনে কি থাকতে পারে আন্দাজ করে আমি মতামতের ঝুলি উজাড় করি এবং শতকরা নব্বুই ভাগ ক্ষেত্রে আমার সে বহিঃপ্রকাশে অনেক ভুল থাকে, সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেটা হয় বলেই আমারও জেদ বাড়ে নিজের সামাজিক অস্তিত্বকে জাহির করবার। পরম ভরসার কথা একটাই, স্বপ্না আমার পক্ষ নেয় অবধারিতভাবে, আর আমি সেই খড়কুটো ধরে ভেসে উঠি। এই umpire-টিকে আমি ৩২ বছর ধরে পাশে পেয়ে আসছি, তাই সহজে বোল্ড আউট করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে প্রতিপক্ষের ক্ষেত্রে। 

এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ যে আবার বড়োই আপন - তাই ওদের ইচ্ছের বাস্তব রূপই আমাদের একমাত্র মানসিক পূর্ণতা। তবু সেই ভুলটা করেই ফেললাম, 'তোরা যেখানে মন চায় আনন্দ করে খাওয়া-দাওয়া কর না, আমরা Chinese কিছু পেলে খেয়ে নেব'। বুবলু - 'বাবা, Glenary's একটা Continental Cuisine রেস্তোরাঁ - ওখানে চিনে খাবারও পাওয়া যায়'। বিশ্ব-করোনার গায়ে গায়ে চিনে খাবারের প্রতি কেন যে হঠাৎ প্রীতি জাগল, নিজেই ভেবে পেলাম না। আরো বুঝলাম না, Glenary's যে কন্টিনেন্টাল রেস্তোরাঁ - সেটাও মাথায় এল না কেন ? স্বপ্না সামাল দিল, 'আরে চল না, আগে হেঁটে পৌঁছোই ম্যাল-এ। তারপর তো প্রচুর খাবারের দোকান - আমরা ঠিক কিছু-না-কিছু খেয়ে নেব'।

আজ সকালে খান তিনেক সোয়েটার-জ্যাকেটের অভ্যন্তরে বুকের কলিজেটুকু জাপটে পা ফেললাম হোটেলের বাইরে। সকালে মিষ্টি রোদে কাঞ্চনজঙ্ঘা আবার দেখা দিয়েছিল, তার রূপশ্রী আবছা হতে শুরু করলো বেলা বাড়ার সাথে সাথে - আমরাও বেরিয়ে পড়লাম ৯০০ মিটারের শেষপ্রান্তে ওই স্ট্যাচু-র কাছে পৌঁছতে, যে অংশটি দার্জিলিং ম্যাল-এর মধ্যবিন্দু এবং আপনাকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘিরে রয়েছে ব্রিটিশ ও ভারতীয় স্থাপত্য, পাহাড়ের ঘেরাটোপে। স্ট্যাচুটি নেপালি কবি 
ভানুভক্ত আচার্যের, যিনি নেপালি ভাষায় রামায়ণ লিখেছিলেন। এই স্ট্যাচু-র ঠিক পিছনেই এম্পিথিয়েটারের মতো তৈরী হয়েছে, সেখানে পর্যটক ও স্থানীয় মানুষ বসে রোদ পোহাতে পারেন। বিশাল LED স্ক্রিনে দার্জিলিঙের আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুকে তুলে ধরা হচ্ছে। বেলা এগারোটা বেজেছে, রোদ পড়েছে ম্যালের মধ্যিখানে, মেঘের ফাঁক দিয়ে ছায়া-আবছায়ায়।


সবচাইতে পুরোনো দোকান অক্সফোর্ড বুক স্টোর, ব্রিটিশ সময়ে প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তৈরী হয়েছিল - সে আজ ওই সময়কে তুলে ধরছে দোকানের অন্তর্বর্তী সাজসজ্জায়। ভিক্টোরিও যুগে ব্রিটিশরা দার্জিলিঙের ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে লন্ডনের অনেক মিল দেখে এই হিল স্টেশনটি তৈরি করেছিল তাদের আভ্যন্তরীন উচপদস্থ কর্মচারীদের থাকবার বা ছুটি কাটাবার কারণে। ৭০০০ ফুট উচ্চতায় এই ম্যালে দাঁড়িয়েই বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ আরো ১২টি শৃঙ্গ স্পষ্ট দেখা যায়। যা দেখবার নেশায় ভ্রমণ-পিপাসুর ভীড় প্রায় সারা বছর ধরেই এই দার্জিলিং-এ। ম্যালের যেদিকটায় রোদ পড়ছে না, সেখানেই হু-হু কাঁপুনি। জ্যাকেট বা ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সকলেরই রোদের পিছনে ছুটোছুটি। বসবার জায়গা (সেটা যথেষ্টই) দু'ভাগে বিভক্ত - রোদ্দুর কিংবা ছায়া মাখা। স্বাভাবিকভাবেই রোদ্দুরে ভীড় বেশি, আর যারা জায়গা পেলেন না, হাওয়ার প্রকোপ থেকে বাঁচতে তারা আশপাশের দোকানে ঢুকে সেখানের শিল্প-কীর্তিতে মগ্ন। আমরা ঢুকলাম আরেকটি অত্যন্ত পুরোনো দোকানে - যার নাম হাবিব মল্লিক & সন্স। স্থানীয় হস্তশিল্পের অভাবনীয় সম্ভার। বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে যখন দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন সূর্য অস্তাচলে। ম্যালের জমজমাট পরিবেশ অদৃশ্য। পাহাড়ে এই এক মজা। সন্ধ্যে হলো তো একে একে দোকানপাট বন্ধ, লোক চলাচল নামমাত্র। তখন হোটেলে ঢুকে পড়া ছাড়া বা কোন রেস্তোরাঁতে সময় কাটানো ছাড়া 
পর্যটকের আর কোন বিকল্প নেই। 




আমরাও হাঁটা লাগালাম হোটেল-পানে। আর হ্যাঁ, বলতেই ভুলে গেছি - দুপুরের খাওয়াটা দারুন হলো। কেভেন্টার্সের উল্টো দিকেই নতুন শাখা খুলেছে কলকাতার "১৬-আনা বাঙালি" রেস্তোরাঁ। আমরা চারজন এঁচোড়ের ডালনা, রুই-মাছের ঝোল, চিতল মাছের পেটি সহযোগে পরিপাটি আহারে কার্পণ্য করিনি। ছেলেরা Glenary's-এই তাদের রসনা পূর্ণ করেছে। আমরাও হোটেলে ফেরার পথে Glenary's-এ কিছুটা সময় কাটিয়ে এলাম অনবদ্য fruit কেক ও দার্জিলিং চা-এর  যুগলবন্দির স্বাদে নিজেদের মজিয়ে নিয়ে। 

রাতের খাওয়া হোটেলেই সেরেছি। আজকের ডায়েরি লেখা এখানেই শেষ করলাম। বাকিটা লিখব কলকাতায় ফিরে। কাল আমাদের sight-seeing ট্যুর। পরশু দার্জিলিং ছেড়ে যাব আধঘন্টার দূরত্বে 'ঘুম' নামক পাহাড়ী উপকণ্ঠে। কিন্তু এখন আমার চোখে ঘুম মাত্র এক লহমার দূরত্বে। 

তাই ........ শুভরাত্রি। 
(c) tapan basu. all rights reserved
photo courtesy : author

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু