সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-১৩) | Sobujdweeper Diary Ep#13

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-১৩
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 29th February 2020 । রাত  ১০টা .........


বাসের সকলেরই ঘুম-তন্দ্রা ছুটল। সুন্দরবনের অসুন্দর আলোচনা দূরে সরিয়ে জারোয়া-বৃত্তান্তে মৃদু কোলাহল-মুখর হলাম সবাই। জারোয়া যে সশরীরে এখনও বর্তমান, এহেন নির্ভেজাল দৃষ্টান্তে প্রত্যেকেরই চোখে-মুখে তৃপ্তির আভাস। কিন্তু বিস্ময় বাকি ছিল -
ম্যানেজার রঞ্জিত মৃদুস্বরে বললে, 'তপনদা, সামনে তাকান, একদম কথা বলবেন না'। আমি কিছু দেখার আগেই ঐ একই কথা পিছনের সিটে রিলে করলাম। এই প্রক্রিয়ায় বাসের শেষ সিট্ পর্যন্ত রঞ্জিতের অমোঘ বাণী গিয়ে পৌঁছলো এবং আমরা কিছু দেখবার প্রতীক্ষায় স্থাণুর মত যে যার সিটে অতি উত্তেজনায় ফেভিকল হলাম। পলকহীন চোখ সরাসরি সামনের পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উইন্ড স্ক্রিন-এ। রাস্তার বাঁদিক বরাবর এক জারোয়া মহিলা এগিয়ে আসছে আমাদের বাসের দিকে। কপাল থেকে নীল-লাল-কালো রঙের একটা চওড়া হেয়ার ব্যান্ডের মতো দেখতে সুদৃশ্য বন্ধনীর উপরে তিনটি রঙিন পালক। এই নারীর শরীর সম্পূর্ণ নিরাভরণ, বে-আব্রু। ডানহাতে ধারালো কাস্তের মতো অস্ত্র, সুরক্ষার ম্যাসকট। পিঠে কিছু দিয়ে আটকানো রয়েছে একটা বর্শা - যার মুখটা বেশ সুচালো।  আমাদের বাস থেমে গেছে - থমকে গেছে আমাদের হৃদ্স্পন্দন - একলাফে আমরা টারজানের দেশে। এদিকে রাস্তার ডানদিক দিয়ে আর একটি প্রায় সমবয়সী যুবক এক্কেবারে আমাদের বাসের ড্রাইভারের জানলার সামনে। আমি ও স্বপ্না ঠিক ড্রাইভারের পিছনের সিটে, সুতরাং আমাদের মধ্যের দূরত্ব ঠিক তিন ফুট।

জারোয়া ছেলেটি কিছু চাইছে। ড্রাইভার জানলার কাঁচ নামালো। ছেলেটির কণ্ঠ থেকে এমন এক আওয়াজ বের হলো, যা আমাদের গলার আওয়াজের সঙ্গে মেলে না। ঘড়ঘড়ে গলায় হলদে রঙের দাঁত বার করে 'পানি' চাইল। অন্ততঃ ড্রাইভার তাই শুনল।  বাসে রাখা একটা দু'লিটারের জলের বোতল দিতেই পুরুষ জারোয়ার মুখে যে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল, তাতে দেখলাম - ওপরের মাড়িতে দু'পাশের দাঁত দুটো বেশ বড় আর মধ্যিখানেরগুলো হাওড়া ব্রিজের মতো সাজানো - বড়ো থেকে ছোট, তারপর আবার বড়ো হয়ে একটা সামঞ্জস্য রচনা করেছে। এরও কপালে রঙিন পট্টি বাঁধা, সেখানে তিন/চারটি নানা রঙের পালক। হাতে সূচাগ্র বর্শা। পরনে কিছু নেই বললেই সঠিক হয়। সুন্দর সুঠাম দৈহিক গঠন। লম্বাটে চেহারায় অতি কালচে-নীল গায়ের রং, আর চোখের মণিও ঘোলাটে। এতো কাছ থেকে এমন এক বিরল উপজাতিকে দেখতে পাব, তার কথা শুনব - এমনটা সত্যিই আশার অতীত ছিল। এই জারোয়া উপজাতিরাদের সংখ্যা এখন মাত্র চারশো'তে এসে ঠেকেছে - আর এরা এই আন্দামানেরই বাসিন্দা। শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় দু'হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এক জংলী প্রজাতি হিসেবে এই আন্দামানে বসবাস করছে। মনে করা হয়, এদের মূল উৎস আফ্রিকার জঙ্গল, যারা এখনো কাঁচা মাংস খায়। যদিও আমি কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে বর্তমানে এরা আগের থেকে অনেক বেশি সভ্য হয়েছে, এমনকি সরকারি সাহায্যে এদের বাচ্চারা স্কুলেও পড়াশুনা শুরু করেছে। মনে পড়ল, প্রথম যে তিনজন জারোয়া কিশোরকে দেখেছিলাম, তাদের পরনে কিন্তু জামা-প্যান্ট ছিল। সেগুলোর ফিটিংস এতো সুন্দর যে তখনি সন্দেহ হয়েছিল, এদের টেইলার কি জঙ্গলেই থাকে ? 

জারোয়া ছাড়া আরো দুটি লুপ্ত-প্রায় উপজাতি আন্দামানে রয়েছে - ওঙ্গা ও সেন্টিনেলি - যাদের সঙ্গে এ যাত্রায় আমাদের দেখা হলো না। একটা কথা বলা বাকি রয়ে গেল - এদের চোখে মুখে যে ভয় আমি লক্ষ্য করেছিলাম, সেটা যে আমার চোখের ভুল ছিল না, তা বুঝলাম পরের দিন 'সমুদ্রিকা মেরিন ওয়ার্ল্ড' ঘুরতে গিয়ে। তিনি কিছু অদ্ভুত তথ্য দিলেন। 

কি বললেন তিনি ? শুনব নিশ্চই, তবে এর পরের পর্বে। 

চলবে .....

আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।  
©tapanbasu
photo courtesy : searchandaman/pinterest/indiaTVnews

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু