সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-৯) | Sobujdweeper Diary Ep#9
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-৯
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 28th February 2020 । রাত ১১টা ........
আশঙ্কা যেখানে অমূলক, দুশ্চিন্তা সেখানে অহেতুক যন্ত্রণার উৎস। সেই ব্যামোতেই আমাদের বেশ কয়েকজনের রাতে ভাল করে ঘুমই হলো না । সবাই ঘুম থেকে ও বাসে সময়মত উঠতে পারব কিনা, এই ছিল দুশ্চিন্তার প্রধান হেতু। এরপরে আবার ৪৭ কিলোমিটার রেইন ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে পথ পেরোনো - সব মিলিয়ে উত্তেজনার পারদ মধ্য রাতের হালকা ঠান্ডাতেও উর্দ্ধগামী।
দেখলাম, কুন্ডুর স্পেশাল নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের দলের প্রত্যেকটা পরিবারই রাত দেড়টার অনেক আগেই লবিতে উপস্থিত। শৃঙ্খলার সঠিক অনুসরণের কারণে তাদের হাবে-ভাবে দিগ্বিজয়ের অনুচ্চারিত আভাস। বাস ছাড়ল যথাসময়ে পৌনে দুটোয়। রাতের আন্দামান একদম শুনশান - হাতে গোনা কয়েকটা গাড়ির হেডলাইট চোখের ওপর দিয়ে ক্ষণিকের চমক জাগিয়ে গেল। আমাদের বাস সাউথ আন্দামান ছেড়ে প্রথমবারের জন্যে এগিয়ে চলল মধ্য ও উত্তর আন্দামানের দিকে। প্রায় সাতচল্লিশ কিলোমিটার পথ পার হতে হবে ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে, যেটা নাকি পুরোটাই আন্দামানের সবচেয়ে পুরনো উপজাতি জারোয়াদের এলাকা। তাই, এখানে চেকপোস্ট পার করতে হবে, কোন খাবার-দাবার, জলের বোতল প্রকাশ্যে রাখা চলবে না। মোবাইল ফোন জমা রাখতে হবে ম্যানেজারের কাছে। ছোটবেলা থেকেই জারোয়াদের গল্প শুনেছি নানাজনের কাছে। এরা নাকি গাছের আড়ালে লুকিয়ে আগন্তুকের গতিবিধি নজর করে, প্রয়োজন পড়লে বিষ-মাখানো তীর ছোঁড়ে বলিউড স্টাইলে একেবারে সঠিক নিশানায়। শত্রূ ধরাশায়ী হয়, কিন্তু এদের ধরা যায় না। এদের গায়ের মিশমিশে কালো রং গাছের আড়ালে অন্ধকারের রঙে মিশে গিয়ে প্রায় অদৃশ্য-মানব বা Invisible Man করে তোলে।
বাস্তবের মাটিতে রূপকথাও কখনো কখনো সমীহ আদায় করে, ঠিক যেমনটা আমাদের হলো। ছাড়পত্র পেতে হলো ভোর পাঁচটা। সূর্যের আলো বিশ্রাম-শেষে আত্মপ্রকাশের পথে। আমাদের নিদ্রাহীন চোখ ও মন এক নিঃশব্দ অনুভূতি নিয়ে জানলা দিয়ে জারোয়া-দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। ড্রাইভাররা প্রায় প্রতিটা দিনই এ পথে চলে বারবার। সুতরাং তারা মোটামুটি জারোয়াদের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এহেন বোধশক্তি যে মুহূর্ত থেকে আমাদের মস্তিষ্কে নড়াচড়া শুরু করেছে, তখন থেকেই আমরা ড্রাইভারের মুন্ড-আন্দোলনে সাথী হয়েছি। সে বাঁয়ে তাকালে আমরা নিমেষে বাঁয়ে ঘুরি, সে গাড়ির গতি মন্থর করলে আমরা অধীর আগ্রহে অর্জুনের একাগ্রতায় দু'পাশের জঙ্গল চষে ফেলি। এক অসীম ধৈর্য ও রোমাঞ্চের সেলুলয়েড !
কিন্তু হায় রে ! প্রায় দু'ঘন্টার বাসভ্রমণে দু'ডজন হনুমান ছাড়া আর কারোর দর্শন পেলাম না - জারোয়া তো দূর অস্ত। আমাদের সকলেই ঈষৎ বিমর্ষ - যেন জারোয়া দেখতে না পাওয়াটা এ জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। ডাক্তার চৌধুরী বললেন, 'সুন্দরবনে তবু বাঘের পায়ের ছাপ দেখায় লোকাল গাইড। এদের তো ছায়াও দেখবো বলে মনে হয় না'। আমারও যে সেরকম মনে হচ্ছিল না, তা নয়। আসলে উন্নতির হাতে দুনিয়ার বদল কখনো কখনো স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করে। এখানে বাস-পথে যেমন লক্ষ করলাম, কিছু দূর অন্তর মাঝে মধ্যেই ছোট ছোট কুটির মতো, পথিকের জন্যে বিশ্রামের ছাউনি। মাত্রাতিরিক্ত গাড়ি, শব্দ-দূষণ, চোরাশিকারিদের রুখতে বনশিকারীদের টহল - এতো কিছুর আয়োজন হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা নিভৃত জীবনকে বিব্রত করে।
যাই হোক, রঙ্গত নামে এক জেটিতে আমাদের বাস গিয়ে দাঁড়াল। এরপর ছোট একটা backwater, অনেকটা খাঁড়ির মতো দেখতে, সেটা পার হলাম লঞ্চে করে - মিনিট কুড়ির পারাপার। বাসে যেতে যেতে ম্যানেজার জানিয়েছিলেন আজকের ভ্রমণসূচী - 'রেইন ফরেস্ট পার করে রঙ্গত জেটি, সেখান থেকে স্পিড বোটে করে বারাটাং আইল্যান্ড। যেখানে প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালে তৈরী 'লাইম স্টোন cave'। প্রায় আড়াই কিমি রাস্তা হেঁটে যাতায়াত'।
বারাটাং আইল্যান্ড-এ পৌঁছোবার পর কিছু বয়স্ক মানুষ লাইম স্টোন কেভ যাওয়া থেকে বিরত থাকলেন। তাঁরা বারাটাং দ্বীপের মধ্যেই এদিক ওদিক ঘোরাটা শ্রেয় মনে করলেন - এঁদের হাঁটু হাঁটবার বিপক্ষে। যাঁদের উৎসাহে শরীরের নিম্নাঙ্গ সহযোগিতার পা বাড়ালো, তারা এবার যাব লাইম-স্টোন কেভ দেখতে। আট জন করে এক একটা স্পিড বোটে করে আমরা এগিয়ে চললাম ছোট ছোট খাঁড়ি, backwater-কে পিছনে রেখে। ডানদিকে আকাশচুম্বী গাছপালার সারি দিয়ে মোড়া সেই দ্বীপ - যা পার করে আমরা এই অবধি এসে পৌঁছেছি - সেটাই জারোয়াদের চারণভূমি।
ওই ট্রপিকাল রেইন ফরেস্ট-এর ভূমিপুত্র এই জারোয়ারা। সরকারি হিসেবমতো মাত্র চারশো জন জারোয়াকে গণনায় চিহ্নিত করা গেছে। সরকার এদের রক্ষা করতে বহুবিধ কর্মসূচী নিয়েছে ইদানিং। সভ্যতার আধুনিক পর্বে 'এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়' গানটির কথা মনে এল - এই পরিবেশে একেবারে সুপ্রযুক্ত, তবে এখানে জারোয়াদের প্রতি প্রেমের নামগন্ধ নেই। দেখার স্পৃহা রয়েছে, কিন্তু মিলনের আকুলতা নেই। ইতিহাস বইয়ের গোড়ার কথায় আদিম গন্ধ আর শেষের পাতায় আধুনিক সভ্যতার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলুক এই জলধারা - নির্বাক সাক্ষী হয়ে।
তীরে নামলাম - ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে Lime Stone Cave এর পথ ধরলাম। আজ এবার খুব ঘুম পাচ্ছে, রাতও বেশ গভীর হয়ে নিশ্চুপ। অনেকটা লেখা বাকি রয়ে গেল। কিন্তু আর পারছি না - হাতের লেখাটাও ক্রমশঃ জড়িয়ে আসছে। Good Night .........
চলবে .....
আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
©tapanbasu
all image clicks : tapanbasu(author)
Comments
Post a Comment