সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-৮) | Sobujdweeper Diary Ep#8

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-৮
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 28th February 2020 । রাত  ৯টা ........


আজকের জার্নিটা একটু বেশিই হয়েছে। আমাদের এই দলে বেশির ভাগই প্রৌঢ় - এদের মধ্যে সন্তানসহ এসেছেন এমন তিনটি ফ্যামিলি পেলাম। বাকিরা বয়সকালের গন্ডি পেরিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে আস্থা ও নির্ভরতার মধুচন্দ্রিমা। ভালোবাসার রূপ যদি অন্যের চোখে প্রতিভাত হয় বা ধরা পড়ে, তখন আশপাশের পৃথিবীটাকে নতুন করে ভাল লাগে। আজকের ভোর রাতের দলবদ্ধ তোড়জোড় আর সারাদিনের শারীরিক ধকল নিয়ে অপূর্ব এক ভ্রমণ-পরবর্তী আমেজ এমন করেই পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ভালবাসার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসকে রাজ-সমারোহে চোখের সামনে এনে বসিয়ে দিল। কেন এমন মনে হলো আমার, সে কথা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠা মুহূর্তগুলোই বলে দেবে। 

মাঝরাত্রে মাঝরাস্তায় সবে-জন্মানো বিড়ালছানা
ডাক্তার চৌধুরীর খুব কষ্ট হয়েছে আজ। আসলে অনেকটা বাস-জার্নি, তার ওপর বারাটাং দ্বীপেও বেশ খানিকটা চড়াই-উৎরাই ওনাকে খানিকটা কাহিল করেছে। ডাক্তার বৌদিকে সপ্রশংস মুখে বলতে শুনলাম, দৈনন্দিন কাজের প্রেসার, ছেলেকে মানুষ করা থেকে সরকারি দপ্তরে নিয়মের প্রবল কড়াকড়ি - চারিদিকের এই চাপে কেমন করে ডাক্তারের এমন শারীরিক যন্ত্রণার উদয় হলো। ডাক্তারের পাশাপাশি বৌদির মানসিক যন্ত্রণাও উপলব্ধি করলাম। কিভাবে যেন এই কুন্ডু স্পেশালের সব ক'টি পরিবার বেশ কাছাকাছি হয়ে পড়েছিলাম এই ক'দিনে। পারিবারিক বন্ধুত্বের পরিধি যেন বাড়তে শুরু করেছে। সোমনাথদা আর বৌদি আমাদের চার জনকে জড়িয়ে ধরেছেন ছায়ার মতো। আমরা যেভাবে এই সবুজদ্বীপকে উপভোগ করতে চাইছি, ওনারাও যেন আমাদের চোখ দিয়ে সেভাবেই উপলব্ধি করতে চাইছেন তাদের বৃদ্ধ বয়সের এই সহাবস্থানকে।

'আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, 
খুঁজি তারে আমি আপনায় -

মূল্যের বিনিময়ে বিচার করবার থেকে সহস্র হাত দূরে এই অনুভূতি, এই মুহূর্তের দ্বীপবাসিনীদের প্রকৃতির আদরে ভেজা মনের ভেতর গড়ে ওঠা আরেক নতুন কোমল মনের ঠিকানা। 

সমস্ত ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা এই ডায়রির পাতায় হয়তো স্থান পেল না, তবে সেগুলো আবার নতুন করে আমাকে এক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল - যার উত্তরও হয়তো আমার নিজের মতো করে জানা। পরিবার আসলে একটি সুবৃহৎ চেন - শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলতার আবহে এক গভীর ভালবাসা - পারস্পরিক ও মানসিক বোঝাপড়ার মেলবন্ধন। পরম্পরা তৈরী হয় সময়ের সিঁড়ি বেয়ে। তাকে নতুন করে গড়ে তুলতে গেলে বা ধরে রাখতে গেলে এই সুবৃহৎ চেনকে ভাঙলে চলবে না। বাঙালি পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের একটা বিরাট অংশ এই পরিবারতত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। যে প্রজন্ম আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে চিরাচরিত বিবাহ-প্রথাকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে না। বিবাহের নিয়মনিষ্ঠ বন্ধন নয়, খোলামেলা দায়হীন বন্ধুত্বের পরিচয়েই তারা বাঁচতে চায়। এতে আগামীর পৃথিবী জনসংখ্যা বিস্ফোরণে কতটা রাশ টানতে পারবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, তবে এদের পরের প্রজন্মের সামাজিক আসরে পূর্বসূরীদের নিয়ে পারিবারিক ইতিহাস-চর্চার গল্প-বৈঠকী যে অদৃশ্য হবে মহাকালের হাতে, তাতে সন্দেহ-প্রকাশে কোন দ্বিধা অন্ততঃ আমার নেই। 

ম্যানেজার বলে দিয়েছিল, রাত ১টা ৩০মিনিটে সকলকে লবিতে জড়ো হতে। এই ক'দিনে খাওয়ার টেবিলে একে অপরকে যেটুকু মাপতে পারা গেছে, তা থেকে প্রত্যেকের মনেই অন্যকে নিয়ে সংশয় ছিল যে একসাথে এক সময়ে আমাদের তিনটে বাস ছাড়া সম্ভব কিনা, তাও কিনা ঐ মাঝরাতে। তাই কাল আমরা প্রায় প্রত্যেকেই মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়েছিলাম, এছাড়া কুন্ডু স্পেশালের স্পেশাল অ্যালার্ম তো ছিলই। কুন্ডু স্পেশালের all-in-one সঞ্জয়ের হাতের সুস্বাদু গরম চা যে ভোর-ঘুম ভাঙানোর সেরা অ্যালার্ম-ঘন্টা। যেহেতু অনেকেই সিনিয়র সিটিজেন, তাই আমার আবার বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল যে প্রাতঃকাল না পড়তেই মধ্যরাত্রে প্রাতঃকৃত্য সমাধা করে সকলের পক্ষে সঠিক সময়ে বাসে ওঠা আদৌ সম্ভব কিনা। 

আমার রাত্রি-নিশীথের দোলাচল কেমন করে স্থিতি পেল সে গল্প আগামী পর্বে আগামীকাল। 

চলবে .....

আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।  
©tapanbasu
all image clicks : tapanbasu(author)

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু