সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-১২) | Sobujdweeper Diary Ep#12

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-১২
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 29th February 2020 । রাত  ১০টা .........

জারোয়াদের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে

Lime Stone Cave দেখে স্পিড বোটে করে বারাটাং দ্বীপের মূল সীমানায় পৌঁছলাম। গাড়ি অপেক্ষাই করছিল, আমাদের নিয়ে এল খুব ছিমছাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি হোটেলে লাঞ্চ-এর জন্য। প্রায় দুপুর দু'টো বাজতে চলল। তিনটের মধ্যে আমাদের রঙ্গত জেটি পার হতে হবে - নইলে আজকের মতো ফেরা বন্ধ। এই ট্রপিকাল রেইন ফরেস্ট বা রিসার্ভ ফরেস্ট, যেটা আদতে জারোয়াদের বাসভূমি, তার দু'প্রান্তে প্রবেশের বেশ কড়াকড়ি। দিনে মাত্র চারবার এর অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায় সঠিক পরিচয়পত্র অনুমোদন-সাপেক্ষে। সকাল ছ'টা, বেলা ন'টা, দুপুর বারো'টা ও বিকেল তিন'টে - এই চারবার দু'প্রান্তের মূল দরজা খোলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী দিনে একশটির বেশি গাড়ি বা যানবাহনের ঢোকবার অনুমতি নেই এই অঞ্চলে। 

আমরা সকলেরই দ্বিপ্রাহরিক আহার যথাসময়ে সাঙ্গ করে নিয়মের বেড়াজাল আরেকবারের মতো ডিঙিয়ে বাসে চড়লাম হোটেলে ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে। গতরাতে কারোরই প্রায় ঘুম হয়নি - বাস ছাড়তেই মোটামুটি সকলেই, মানে আমাদের বাসের চোদ্দ জনের চোখেই তন্দ্রা ঘনিয়ে এল।  আবার সাতচল্লিশ কিলোমিটার পথ পার করতে হবে 'জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্ট'এর মধ্যে দিয়ে। ডাক্তারের চোখে ঘুম কম, তিনি অরুণদার ঝিমুনিকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, "আসলে এখন জারোয়ারা সরকার থেকে প্রচুর সাহায্য পায়, সুতরাং ওদের আর রাস্তায় দেখতে পাবার কোন আশা নেই"। তাছাড়া সত্যি বলতে কি, এটা অনেকটা ঐ সুন্দরবনে বাঘ দেখবার মতো - অনেক pre-conditions সেখানে - বাঘ দেখতেও চাই, কিন্তু এমন দূরত্বে যাতে জীবনের ঝুঁকি না থাকে; আবার সেটা বেশি দূরে হলেও চলবে না, কারণ ক্যামেরাবন্দি তাকে করতেই হবে নইলে Facebook বেচারি অনাহারে থাকবে তো !

জঙ্গলে ঢোকার আগে গাড়ির সারি

ডাক্তার বললেন, 'এতো pre-conditions মেনে তাই বাঘেরা আর এদিক মাড়ায় না, Local Guide চলমান স্পীড বোট থেকে অসামান্য কল্পনা-জালে নিকট দূরত্বের বাঘের পায়ের ছাপের ছবি আমাদের মনে এঁকে দেয়। আমরা ফিরে এসে যাতে বলতে পারি টাটকা পায়ের ছাপ (অবশ্যই সেটা বাঘের) দেখেছি - মনে হয় ঘন্টা ছ'য়েক আগেই এ পথ দিয়ে গেছে, তার তৃষ্ণা মিটিয়ে। হঠাৎ করে মনটা আন্দামান থেকে সুন্দরবনে চলে গেছিল, illusion-এ বাঘের ছায়া তখন পড়েছে জলে। 

পথের ধারে

চমক ভাঙল ম্যানেজারের ডাকে, "ঐ দেখুন, আপনার ডানদিকে জারোয়া, কেউ কথা বলবেন না"। বাসের গতি একটু কমায় ভাল করে দেখলাম তিনটি অল্প-বয়সী জারোয়া কিশোরকে। রাস্তার ধারে উঁচু হয়ে থাকা গাছের আলে বসে অপেক্ষা করছিল ওপারে যাবে বলে। একজনের হাতে সরু গাছের ডাল, দাঁত দিয়ে তাতে ছিলে কাটছে। অনেকটা নিমদাঁতনে যেমন গ্রামের লোকেরা আজও দাঁত মাজে। এদের চালচলন একদম সাধারণ, দেখে মনে হলো বছর কুড়ি'র কোঠায় এদের প্রত্যেকেরই বয়স। পরনে শার্ট-প্যান্ট। যেহেতু আমি এবার ডানদিকের সিটে বসেছিলাম, তাই দু'হাত দূরত্বে ওদের মুখটা লক্ষ্য করলাম, মনে হলো ওরা আমাদের ভয় পায়। বাস্তবে আমাদের উল্টো চিন্তাটাই মনে প্রশ্রয় পায়। বাসের গতি একটু কমতেই তারা একছুট্টে রাস্তার ওপারে গিয়ে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

ওদের এই ভয় কি আধুনিক সভ্যতাকে ? কি জানি ! উত্তর জানবার তো কোন উপায় জানা নেই !

একটা বিষয় শুধু স্পষ্ট হলো, সভ্যসমাজের অন্তরালে থাকাটাই এরা বোধ হয় শ্রেয় মনে করে। নইলে তাদের অধিকারের বাসভূমিতে আমাদের মতো অনুপ্রবেশকারীদের ভয় পাবার তো কোন কারণ থাকে না !

বাসের সকলেরই ঘুম-তন্দ্রা ছুটল। কিন্তু তাতে কি কিছু লাভ হলো ?  তারপর কি হলো ? সব উত্তর পরের পর্বে, আগামী বুধবার।   

চলবে .....

আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।  
©tapanbasu
photo courtesy : tapanbasu (author) / worldatlas / andamanchoricle / economictimes

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু