সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-১১) | Sobujdweeper Diary Ep#11


সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-১১
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 29th February 2020 । সকাল ৭টা .........


বলছিলাম গুহা-পথের রোমাঞ্চের কথা। গাইড তো আমাদের আর এগোতে বারণ করল। আমরা পুরো দল তার কথায় মোমের পুতুল হলাম। সে দেখিয়ে দিল কিভাবে শরীরকে নানা কসরতে এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করাতে হবে। যেমন হয় সাধারণতঃ - এই গুহারও প্রবেশপথ বেশ সরু। নানা দেহভঙ্গিমায় ভিতরে ঢুকতে হবে, যেটা আমাদের দলের প্রাচীন সদস্যদের কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ইচ্ছেশক্তির জোর অনেক বেশি। ইতিমধ্যেই কয়েকজন হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করেছেন, জমে থাকা কলিজা নিয়ে জমাট বাঁধা Limestone Cave-এ ঢুকবেন বলে। 

কিছু না কিছু শারীরিক বিভঙ্গে প্রায় সকলেই প্রবেশ করতে পারলাম গুহার অভ্যন্তরে - মুখে বিজয়ীর গর্বিত আভা - যদিও তা উপলব্ধি করা গেল না সেভাবে - কারণ ভেতরটা খুব অন্ধকার। স্যাঁতস্যাতে গন্ধময় এর অন্দরমহল। আসলে আন্দামানের পুরো ভ্রমণটাই একটা ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্ট। প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়ে ওঠা অপরূপ সৌন্দর্যের অনির্বাণ দৃশ্যায়ন। সম্মোহিত হই, মনে হয় এই বিস্ময়-সৃষ্টি জীবন্ত হয়ে আমার চোখের সামনে যেন  নৃত্যভঙ্গিমার নানা আবেদনে মনোরঞ্জনের পসরা সাজিয়েছে। চোখ বুজে আত্মস্থ করলে স্বর্গীয় প্রবাসে ইন্দ্ররাজসভায় ঊর্বশীর নাচ বলে ভুল হতে পারে। কল্পনা মানুষকে উৎসাহ যোগায় - মস্তিষ্কে উত্তেজক কোষের উন্মেষে জেগে ওঠে নানা প্রশ্ন।

এই গুহা কবে তৈরী হল, আর কি করেই বা ? গাইড বলল, আসলে এখন আমরা যেখানে আছি, সেটা লক্ষ লক্ষ বছর আগের সমুদ্রতল। গুগল বলল, এখানে নানা প্রজাতির শ্যাওলা-জাতীয় উদ্ভিদ - ইংরেজিতে যাকে আমরা Algae বলি - তা ছিল Ocean Life-এর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণের স্পন্দন। স্কুল-জীবনে পড়েছি, সমুদ্রের নিচের এই এক-কোষী উদ্ভিদ পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে তৈরী করত অক্সিজেন, সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। জলের মধ্যে এই অক্সিজেন তৈরী করবার জন্যে আমরা বাড়িতে রাখা একুয়ারিয়ামে অনেক সময় শ্যাওলাজাতীয় উদ্ভিদ রাখি - এতে রঙিন মাছেরা জীবন ও ছন্দ, দু'ই খুঁজে পায়।
ইতিহাস বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো সামুদ্রিক জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চারশো কোটি বছর আগে। এই শ্যাওলাজাতীয় উদ্ভিদ নানা রাসায়নিক বিকিরণে সমুদ্রতলে আকার নিয়েছিল বা জন্ম দিয়েছিল চুনাপাথর বা Limestone-এর। ভাবতে অবাক লাগে, আজ যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেটাই আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের সমুদ্রতল। অরুণদাকে বললাম, তোমার 'scuba diving' করবার ইচ্ছে ছিল, Home Ministry থেকে সরকারি অনুমতি পাওনি - আজ এখানেই কল্পনায় সেটা করে নাও, পায়ে হেঁটে। শুধু তোমাকে জীবন্ত রঙিন মাছ, কোরাল আর অক্টোপাস কল্পনায় দেখে নিতে হবে - যা তুমি jollybuoy-তে দেখেছ।


মাথার ওপর দিয়ে কদাচিৎ সূর্যরশ্মির সরু রেখা।  গুহার উপরিতলের গাছ-গাছালির শিকড়ের তরল নির্যাস ও বৃষ্টির জল বাঁচিয়ে রেখেছে এই Limestone-কে। তারা আজকেও জীবন্ত - নব নব রূপে ধরা দিয়েছে বর্তমানে - আমাদের প্রাণে। অজন্তা-ইলোরা'র গুহাচিত্র দেখেছি। সে ছিল মানুষের প্রাথমিক সভ্যতার ইতিহাসের দেওয়ালে আঁকা অবিস্মরণীয় কীর্তি।  আজকের এই গুহাচিত্রের শিল্পী প্রকৃতি নিজেই - তারই অস্তিত্বের তুলি ও কলমে তুলে ধরা শিল্পকর্ম আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব শিল্পসত্ত্বায় বৃষ্টিভেজা সবুজ পাতার স্নিগ্ধ স্পর্শ। গাইড আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, 'ঐ দেখুন, কেমন শুঁড়সুদ্ধ গণেশের মুখ - এদিকে ডাইনোসর - ওই দূরে  এলিফ্যান্ট'। সত্যিই তাই - চুনাপাথরের ওপর জল ও হাওয়ার দীর্ঘদিনের পরশে সৃষ্টি হয়েছে এই সব নানা আকার। মহাদেবের জটা থেকে রবিঠাকুরের দাড়ি, দাঁতালো পশু থেকে পুরোনো মোহর - শুধু আপনার মনের angle থেকে আবিষ্কার করতে হবে। সরু সরু তলোয়ারের ফলা ঝুরি হয়ে নেমে এসেছে অনেক উঁচু পাহাড়ের গা থেকে, নিচে কুমিরের পিঠে। সমস্তটা মিলে জলছবির ক্যানভাস। পুরো গুহা ঘুরে দেখতে মিনিট পঁয়তাল্লিশ যথেষ্ট। সমুদ্রতলের গভীরে দাঁড়িয়ে রয়েছি আর এই সব প্রাকৃতিক সৃষ্টি-কলা দেখছি। মহাসাগরের গভীরের কাল্পনিক চাপ অনুভব করতে করতে ফেরার পথ ধরলাম। জেটিতে এসে অনুধাবন করলাম, আমাদের দলের বেশ কয়েকজনের এতটা পথ আর হেঁটে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সোমনাথদাকে সঙ্গ দিতে বৌদিরও আর দেখা হল না এই limestone cave। বার্ধক্য তাঁর ইচ্ছাশক্তিকে পরাভূত করেছে। আমাদের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবি ও মৌখিক বর্ণনা সাময়িক হলেও এনাদের না যেতে পারার দুঃখে জলছবির রং। স্পিড বোটে চেপে ফেরার পথে সোমনাথদা বলেছিলেন, আপনারা এরপর যেখানে বেড়াতে যাবেন, আমাদের বলবেন। আপনাদের কোন আপত্তি না থাকলে আমরা যাবো। তাঁর কথা আজ খুব মনে পড়ছে, এই ডায়রি যখন লিখছি। কারণ তাঁর এই শেষ ইচ্ছেটুকু এ জীবনে পূরণ করবার সুযোগ আর আমাদের কাছে আসবে না। সোমনাথদা আজ থেকে এক মাস আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক..... অনেক দূরে - মনুষ্য-জীবনের সীমানার ওপারে সৃষ্টিকর্তার একেবারে কোলের কাছে, নিরাপদ আশ্রয়ে। 

এর পর আবার আগামী পরশু, রবিবার।

চলবে .....

আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।  
©tapanbasu
photo courtesy : tapanbasu (author)

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু