সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-৭) | Sobujdweeper Diary Ep#7

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-৭
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 27th February 2020 । রাত ১২টা ........

বেশ ঘুছিয়ে আজকের ডায়েরি লিখতে বসছি। রাতের খাওয়া-দাওয়া মিটেছে অনেক আগেই। Travel Agent-দের লোকজনকে দেখলাম, সেভাবে কেউই ঘুমোয় না। রাত সাড়ে দশটার মধ্যে মিটে যায় সব টুরিস্ট-এর খাওয়া-দাওয়া। তারপর এরা নিজেরা খেতে বসে - একসাথে। কুন্ডু স্পেশালের পক্ষ থেকে মোট ৬ জন লোক আমাদের পুরো দলের দেখভাল করবার জন্যে রয়েছে। এদের মধ্যে ২জন ট্যুর ম্যানেজার, বাকিরা রান্নাঘর ও ট্যুরিস্টদের অন্যান্য প্রয়োজন সামলানোর কাজে ২৪ ঘন্টা ব্যস্ত। ম্যানেজাররা কখন যে পারমিশন জোগাড় করছে, কখন যে গাড়ির ড্রাইভারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অথচ, আমাদের কোন কিছু বলবার আগেই সমস্ত তৈরী। আজ আমাদের নীল আইল্যান্ড যাওয়া। এবার সেই গল্প।

আমাদের ৪২ জনের দলে ১৪ জন আগে থাকতেই বলে রেখেছিল Neil Island যাবে বলে - এর জন্যে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে জনপিছু অতিরিক্ত দিতে হয়।  ২৭ তারিখটা কুন্ড স্পেশাল ফ্রি রেখেছিল, এই জন্যে যে - যার যেমন খুশি এই দিনটা উপভোগ করবে। যেহেতু অনেক ছোট ছোট দ্বীপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আন্দামানের মূল দ্বীপের চারিপাশে, তাই কেউ নিজের পছন্দ-মতো যে কোন দ্বীপে বেড়াতে যেতে চাইলে 'কুন্ড স্পেশাল' ব্যবস্থা করে দেবে, কিন্তু তার যা খরচ হবে সেটা ট্যুরিস্টকেই বহন করতে হবে। অনেকেই শেষ মুহূর্তে Neil Island যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন - কিন্তু যেহেতু আগে বলা ছিল না, তাই শত চেষ্টাতেও Neil-এ যাবার ছাড়পত্র জুটল না ওনাদের। 

ক্ষোভের মেঘ ঘনীভূত হতে না হতেই আমরা ১৪ জন বেরিয়ে পড়লাম নীলের উদ্দেশে। এই দ্বীপকে আপনি অনায়াসে বলতে পারেন, 'The Lost World' - চেনা পৃথিবীর বাইরের কিছু। লঞ্চ-এ করে হ্যাভলক হয়ে Neil পৌঁছতে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা লাগল। এই লঞ্চগুলোতে শ'তিনেক লোক ধরে - একটাও সিট্ খালি দেখলাম না। বুঝলাম, কেন অনেক আগে থাকতে টিকিট কেটে রাখা প্রয়োজন। অত্যন্ত আধুনিক সুবিধাযুক্ত এই লঞ্চগুলো। দারুণ চমৎকার সাজানো-গোছানো অন্দরমহল, লাইভ ফুড কাউন্টার - সাধ্যের মধ্যেই খাবারের দাম। হেঁটে চলে বেড়াবার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে লঞ্চের ভেতর। লম্বা রাস্তা, সমুদ্র-পথে। বেশ দ্রুতগামী এই লঞ্চের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে বিরক্ত ঢেউ - তারা এই উট্কো অশান্তি বরদাস্ত করতে ঠিক রাজি নয়। আমাদের কারোর কারোর শরীরও একই মতের অনুসারী। লঞ্চের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকজনের শরীর একটু বেঁকে বসল। আমাদের দলের মধ্যে অরুণদাসহ ৩/৪জন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, বোট-এর সহযোগীদের তৎপরতায় কোনক্রমে সেটা সামলানো গেল। জেটিতে নেমেই দেখলাম, গাড়ি প্রস্তুত। কাছেই Beach - Neil ডাকছে। 

সত্যিই তাই - নীলই বটে। আকাশ আর সমুদ্রের বিভাজন খুঁজে পাবেন না। মাথার ওপরে ৩৬০ ডিগ্রি ধরে একই নীল - অনেক অনেক উঁচু প্রান্তহীন সামিয়ানা দূরে কোথাও যেন নেমে এসে মাটিতে মিশেছে - তারপর আহ্লাদে গলে জল হয়ে একেবারে আমাদের পায়ের কাছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সম্মোহিত হয়ে যেতে হয়। আমার চটক ভাঙল ম্যানেজারের ডাকে। রণজিৎ বলল, 'এখানে ৩/৪খানা বিচ রয়েছে বটে, তবে এই Bharatpur Beach সবচেয়ে সুন্দর। আপনাদের লাঞ্চ প্যাকেট রেডি আছে - সময়মতো খেয়ে নেবেন। যারা সমুদ্র-স্নানে ইচ্ছুক, তাদের জন্যে MakeMyTrip বেশ বড় Shower Place তৈরী করেছে। নারী ও পুরুষদের আলাদা ব্যবস্থা। সাবান, তেল, গামছাও বিক্রি হচ্ছে। ব্যবস্থায় কোন খামতি নেই - প্রলোভন সংবরণ করা বেশ দুরূহ। 

আমি তো সাঁতার জানি না - কিন্তু এখানকার সমুদ্র অনেকটা সুশীল সন্তানের মতো। জলে নামলে নিয়ন্ত্রণ হারানোর কোন ভয় নেই। আমি আর অরুণদা প্রায় একশ ফুট মতো সমুদ্রের মধ্যে এগিয়ে গেলাম, কোমর-জল - পায়ের নিচে সাদা বালি। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলরাশি। আমি নিজের সাহস দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। বিশাল জলরাশির মধ্যে কেমন একটা 'সবুজদ্বীপের রাজা রাজা' ভাব এলো। চেঁচিয়ে আমার স্ত্রী-কে বললাম, 'দেখো, ওদিকটাতে কত দোকান রয়েছে - তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করব আমরা'। আমার আহ্লাদিত কণ্ঠস্বর স্বপ্নার কানে কতটা পৌঁছলো বলতে পারবো না, কিন্তু মনটা যেন খুশিতে হালকা মনে হতে লাগলো - জলে ভাসতে লাগলাম। সমুদ্রস্নানের পর যথারীতি আবার দারুণ একপ্রস্থ খাওয়া-দাওয়া হলো - অপূর্ব আয়োজন কুন্ড স্পেশালের। মনে মনে প্রত্যেকেই তারিফ করলাম এদের ব্যবস্থাপনার। নানা কেনাকাটায় পকেট একটু বেশিই হালকা হলো, আমারই মানবিক উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়িতে। তবে এটাও ঠিক, বেশ ভালোও লাগছিল। পরিবারের মানুষজনের ভালোলাগাগুলোকে স্বপ্না নিজগুণে সাজিয়ে রাখে নিজের মনের ঘরে। আমরা যেখানেই বেড়াতে গিয়েছি, স্বপ্না সেই ভালোলাগাকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে, মর্যাদা দেবার চেষ্টা করে - ঝুলি ভ'রে তাদের প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা ছোট-বড়ো-মাঝারি স্যুভেনির বা স্থানীয় কারিগরি কাজের নানা সামগ্রীতে একত্রিত ক'রে বেঁধে নেয় তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। এ এক অন্য আনন্দ ! ভালোলাগা ভাগ করে নেবার আনন্দ। যারা সশরীরে সঙ্গে নেই, আসলে তারাও আছেন প্রতি মুহূর্তে, আমাদের প্রত্যেকটি আনন্দের মুহূর্তে। তাই তো ভ্রমণ আসলে সংসার-গণ্ডির পাকদন্ডি থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কোলে মুক্তিস্নান - যেখানে মানুষ নতুন করে নিজেকেই আবিষ্কার করে।

পুতুল জারোয়া কেনা হলো তাদের জন্যে, যারা আসলের মুখোমুখি এখনো হননি - স্টেজ রিহার্সাল করতে পারবেন, এই ভাবলাম। আন্দামান লেখা টি-শার্ট কিনলাম - সুন্দর রং, মোলায়েম কাপড়, দামও বেশ কমই বলা যায় - সব রকম সাইজেরই কয়েকটা করে কিনে ফেললাম - কার কখন ফিট করে ! এছাড়া আরো কিছু স্থানীয় জিনিসপত্র। ফুরফুরে মেজাজে ফেরা হলো হোটেলে, ফেরার পথে লক্ষণপুর বিচ দেখে নিলাম আমরা। এই বিচ ঠিক স্নানের উপযোগী নয়, মৃত কোরালে আর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট জমাট বাঁধা পাথরে ভর্তি। হোটেলে ফিরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুনলাম বাকিরা সেই অর্থে কোন দ্বীপ-ভ্রমণে যেতে পারেন নি। প্রশাসনিক অনুমতি না পাবার কারণে হ্যাভলক ছাড়া অন্য কোন দ্বীপের উদ্দেশে আজ কোন লঞ্চ যাত্রা করতে পারেনি।

                       


দলের বাকি সদস্যদের এমন একটি ঘটনাবিহীন, ভ্রমণহীন দিন কাটানোতে খুবই দুঃখ পেলাম। ডাক্তারবাবুর মনও বেশ খারাপ দেখলাম, উনি Neil-এর দলে ছিলেন না - ওনার সদা সবুজ মন এই প্রথম ফ্যাকাসে লাগল। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমি আর অরুণদা সামনের মাইলখানেক পথে একটু সামুদ্রিক হাওয়া ও আন্দামানী চা খেয়ে এলাম। তারপর একেবারে রাতের খাওয়া সেরে যে যার রুম-এ চলে এলাম একটু তাড়াতাড়িই। আগামীকাল আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ৪৭ কিমি Rain Forest পার করে অন্য এক দ্বীপ-পর্যটন। সেখানে দেখবার কি আছে উহ্য রইল - ম্যানেজাররাও মুখ খুললেন না। 

কিন্তু কেন ? এই অহেতুক রহস্যের কারণ কি ? উত্তর পেলাম না। কারণ খুঁজতে খুঁজতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। 

কি ছিল ওই নীরবতার কারণ ? নিশ্চই বলব, তবে আজ নয় - পরের পর্বে। .........

চলবে .....

আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।  
©tapanbasu
all image clicks : tapanbasu(author)

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু