সবুজদ্বীপের ডায়েরি (আন্দামান পর্ব-৬) | Sobujdweeper Diary Ep#6

সবুজদ্বীপের ডায়েরি । আন্দামান পর্ব-৬
সবুজদ্বীপের ডায়েরি । 26th February 2020 । রাত ১১টা ........


February'র ছাব্বিশ শেষ হতে বেশি বাকি নেই। আজ ডায়েরির পাতা একটু বেশিই লম্বা হয়ে যাচ্ছে, অথচ কিছু করবারও নেই। সারাদিনের অভিজ্ঞতার ডায়রিতে এতটুকুও ফাঁক রাখতে চাই না। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু লেখার গতির তুলনায় তা দুর্বল। 

পকেটে ট্রাম্পকার্ড, থুড়ি - ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে নিয়ে অটো ধরে চললাম মার্কেটের উদ্দেশে। বিকেল তখন সন্ধেতে পা ফেলেছে। রাস্তার আলোয় মাখোমাখো নরম ভালবাসা, সমুদ্রের উদাসী হাওয়ায় সে আলো প্রথম শীতের চাদরের মতো জড়িয়ে রয়েছে আমায়। এমনিতেই বেড়াতে বেরোলে মনের গতি উর্ধমুখী হয়, আর এমন ফুরফুরে আবহাওয়ায় মেজাজ এতটাই শরিফ লাগছে যে সারাদিনের ধকল শরীরকে ছুঁতেই পারছে না। এখানে অটোতে তিনজন বসতে পারে - সামনে চালক একেবারে একা - ডাঁয়ে-বাঁয়ে কেউ ঠাঁই পাবে না। অটোর বেগও পোর্ট ব্লেয়ার শহরের মতো মধ্যগতির। মার্কেট বেশি দূরে নয়। বাঁদিকে একটা লম্বাটে পুরনো আমলের টিনের বোর্ড দেখলাম, সেখানে আন্দামানের মানচিত্র। 

আন্দামানের মূল দ্বীপটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। জিবেগজার মতো দেখতে এই দ্বীপ উত্তর, মধ্যে ও দক্ষিণ - এই তিন ভৌগোলিক সীমারেখায় ভাগ করা। পোর্ট ব্লেয়ার South Andaman-এর মধ্যে পড়ে আর আমরা এই South Andaman-এ সমুদ্রের কাছাকাছি হোটেল King's Tower-এ উঠেছি। পোর্ট ব্লেয়ার আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী এবং এই রাজ্য ভারতের Union Territoryর অন্তর্ভুক্ত। কথিত আছে যে বিভিন্ন প্রাচীন উপজাতিরা কমপক্ষে বিগত প্রায় দু'হাজার বছর ধরে বসবাস করছে এই আন্দামানে। 'এনথ্রোপলোজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র পুস্তিকাতেও সেই তথ্য পাওয়া যায়। 

অটো এসে দাঁড়ালো 'সাগরিকা' নামে এক সরকারি বিপণিতে। সরকার
পরিচালিত এই দোকান পোর্ট ব্লেয়ার-এর প্রাণকেন্দ্র বা Chowk-এর কাছেই। দ্বিতল এই বিপণিতে স্থানীয় কারিগরী হস্তশিল্পের বিপুল সম্ভার। ক্রেডিট কার্ড পকেটে থাকার একটা মস্ত সুবিধে এই যে, দোকানের তাকে সাজানো যে কোন সামগ্রীর দিকেই নির্ভয়ে তাকানো যায়, আর বিক্রেতার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে ও অযাচিতভাবে নিজের সাজানো জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে এই কার্ডের কোনও জুড়ি নেই। এ দোকানে শঙ্খ, ঝিনুক, নারকোলের তৈরী দৃষ্টিনন্দন সম্ভারে স্বপ্নার শরীরের রক্তসঞ্চালন দ্রুতগতি ধারণ করল ও তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে আমি আবার ক্রেডিট কার্ডের কাছে পরাজিত সৈনিক হিসেবে নিজেকে পুনর্প্রতিষ্ঠা করলাম। বিক্রেতাদের সমাদরের মতো সমার্থক কোন আদর যদি নিজের কর্মজীবনে কেউ আমরা এভাবে নিয়মিত পেয়ে থাকতাম, তাহলে চাকরিতে 'ইস্তফা' বলে সাংবিধানিক কোনও শব্দের প্রয়োজন থাকতো বলে আমার মনে হয় না। এত বড়ো দোকানে বিস্তর বিক্রেতাদের আলাদা ডিপার্টমেন্ট, মাল-বিক্রির আলাদা দায়িত্ব। তাদের চোখে-মুখে সেই রবিঠাকুরেরই গানের প্রতিধ্বনি। ...... 
ফিরে ফিরে ডাক দেখি রে, পরান খুলে ডাক, ডাক, ডাক -
ক্রেতার ইচ্ছে ও ক্রেডিট কার্ডের জোর - বিক্রেতা একবার আন্দাজ করতে পারলে এই ডাক  দীর্ঘায়ু না হয়ে যায় কোথায় ! 

গলা শুকিয়ে এসেছে, চা'এর প্রয়োজন। অরুণদা চায়ের অত্যধিক ভক্ত, এতটাই যে চা নামক কিছু একটা তাকে দিলেই হলো। চা'য়ের অদম্য আকর্ষণে অরুণদা বিপদে পড়েছে বলে আমার জানা নেই, তবে সময়ের কাজ অসময়ের বেলা গড়িয়েছে অনেকবার, এ অভিযোগ নিতান্ত অমূলক নাও হতে পারে। কিন্তু এবার অরুণদা নয়, আমার নিজেরই এখন চা'য়ের অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণটা আন্দাজ করা খুব শক্ত নয়। একটু হেঁটেই আলো-ঝলমলে চক-বাজার। সেখানে এক রেস্তুরাঁতে চা পর্ব মিটিয়ে হোটেলে ফিরলাম। আমাদের তিনটি পরিবারের মোট বারোটি হাতে গুনে গুনে বারোখানা কাগজের প্যাকেট - সে প্যাকেট নিজেও যতটা নরমপন্থী, তার ভিতরের বস্তুগুলি তার থেকেও বেশি। Fragile স্টিকার চারিদিকে সেঁটে দিলেও আকাশপথ পেরিয়ে তারা যে অক্ষত শরীরে বাড়ি পৌঁছবে, এমন নির্ভরতা আদৌ নেই। "তবুও শান্তি, তবু আনন্দ .......  

হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের ম্যানেজার পরের দিনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত
শুরু করেছেন। জানলাম আগামীকাল আমাদের Neil Island যাওয়া হবে। এখানকার স্বচ্ছ নীল আকাশ, নীল জলরাশির বাইরে 
"নীল" নামের একটা দ্বীপও রয়েছে। শীত-শেষের সৌন্দর্য্যের অপরিমেয় উপস্থিতিতে এমনিতেই আমাদের মনের ভিতরঘরে শরতের উৎসব লেগেছে, মেজাজ অতীব ফুরফুরে। রাতের ঘুম তাড়াতাড়িই নেমে এলো চোখের পাতায় - টিভি নেই, ইন্টারনেট নেই, মোবাইলে নেটওয়ার্ক চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির মতো - এই আছি, এই নেই। দৈনন্দিন জীবনের এই অবশ্য-প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর সদম্ভ উপস্থিতি থেকে অনেক দূরে আমাদের এই মুহূর্তের জীবন - কিন্তু বড় কাছাকাছি দূষণহীন এই সবুজদ্বীপের দরবার। যেখানে স্রষ্টার নীল চোখের তারায় আমাদের নির্ভেজাল ভাললাগার আবেশের প্রতিবিম্ব। 'নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী ....... আর বিছানায় শুয়ে এই আমি  ....... ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে থাকলাম তন্দ্রা থেকে স্বপ্নের দোরগোড়ায়। 
চলবে .....

আন্দামান ভ্রমণের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।  
©tapanbasu

all image clicks : tapanbasu(author)

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু