বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-২১) | Baro Bismay Jage Ep#21

বড়ো বিস্ময় জাগে 
পর্ব-২১


আজকে এই একুশতম পর্ব লিখতে বসে মন কেবলই জোড়াসাঁকো  ঠাকুরবাড়ির সেই ঘরটায় পৌঁছতে চাইছে, যেখানে কবির শ্রান্ত শায়িত দেহটিকে ঘিরে উৎকণ্ঠিত প্রিয়জনের নীরব প্রার্থনা কান্না হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে বাইরে অপেক্ষমান শত-শত মানুষের হৃদয়, মৃত্যুপথযাত্রী অসামান্য এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিশ্ববাসীর ভালবাসার জমিতে। 

ঘটনাচক্রে আজই বাইশে শ্রাবণ। তাই হয়ত অবচেতনে ভেসে আসছে একটা বিশ্বাস - 'মৃত্যুর পরেও যদি তেমন কোন  জীবন থেকে থাকে, যা' এতটাই জীবন্ত যে তাঁকে ইচ্ছে হলেই আজকেও আমরা ছুঁতে পারি, তিনি তো তখন আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে বিরাজ করেন - অমরত্বের সংজ্ঞা তো তাকেই নির্দেশ করে, তাই না? ঠিক যেমনটি ঘটেছে আমাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। কিন্তু আজ যদি কল্পনায় দেখতে পেতাম ঠিক বাইশে শ্রাবণের দিনটিতে আশিবর্ষীয় রবীন্দ্রনাথের মনের অবস্থা কেমন ছিল ?

..........."এই আশির দোরগোড়ায় আর সেদিনগুলোর কথা ভেবে উঠতে পারি না - বড় শ্রান্ত লাগে। তবু অবসন্ন শরীরে মনে পড়ে পোস্টমাস্টার গল্পে রতনের কথা।  অনাথা বালিকা রতন চাকরিসূত্রে উলাপুর গ্রামে আসা পোস্টমাস্টারের কাজকর্ম করিয়া দেয় - দু'টি খাইতে পায়। সেই পোস্টমাস্টার যখন চাকরিতে ইস্তফা দিয়া ফিরিবার অভিপ্রায়ে নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষা-বিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল - তিনি হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত এক বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন  - একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল।"...............

আজ বুঝি আমারও মর্ত্যজীবনের চাকরির ওপর যবনিকা পতনের সময়ঘন্টা বাজছে। দূরে, ওই দূরে কোথাও বাজছে মঙ্গলশঙ্খ। অথচ, আজ আমার মনে মৃত্যু-আহত দিনগুলো কেন বারেবারে ফিরে আসছে ? সেই জোড়াসাঁকো - যার বারান্দার রেলিংয়ে আমার শাসনতন্ত্রের ইতিহাস - দোতলার উঠোনে বহু কবিতার গান হয়ে ওঠবার অব্যক্ত কাহিনি - আর কি আসবে সেই সব দিন ? সময় যে বড় নিষ্ঠূর ! চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। চিকিৎসার ও সেবার কোনই ত্রূটি নেই, তবু দেহ তো আর চলে না! সত্তর বছরের স্মৃতির শান্তিনিকেতন ছেড়ে কবি চললেন কলকাতা - ৯ই শ্রাবণ (২৫শে জুলাই ১৯৪১)। .......... খুব দেখতে ইচ্ছে করছে শমীকে। 

শমী বলত - 'বাবা ! গল্প বলো' ?
আমি এক-একটা কবিতা লিখতুম আর ও মুখস্থ করে ফেলত, সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে আবৃত্তি করত। ঠিক আমার ছেলেবেলার মত। ছাতের কোণে কোণে ঘুরে বেড়াত - নিজের মনে কত রকম ছিল ওর খেলা ! কেন যে ঘুরেফিরে শুধু ওর মুখটাই ভাসছে আমার চোখের সামনে ?

সেবার পুজোর ছুটিতে শমী বেড়াতে গেল মুঙ্গেরে - বন্ধু ভোলার মামাবাড়িতে।  সেখান থেকে টেলিগ্রাম এল শমীর কলেরা হয়েছে। 
........."তৎক্ষণাৎ ছুটেছিলাম মুঙ্গের। কিন্তু সব আশা-চেষ্টা ব্যর্থ হলো - শমীকে রক্ষা করা গেল না"........

"শমী যে রাত্রে চলে গেল, তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, পড়েনি, পড়েনি  - সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে। সমস্তের জন্যে যে আমার কাজও বাকি রইল।"

এ কোন দেখা ? আমরা সকলেই এ কথা জানি যে, শমীর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অতিশয় দুর্বল ছিলেন। তার এমন অকাল-মৃত্যুতে নিদারুণ আঘাত পাবার পরেও এমন ভাবনা-জাল বিস্তৃত হয় কি করে ?

৩০শে জুলাই (১৯৪১) তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার হলো। কিছু পূর্বেই লিখলেন, 
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি 
বিচিত্র ছলনাজলে হে ছলনাময়ী....... ।
..... অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে 
সে পায় তোমার হাতে 
শান্তির অক্ষয় অধিকার"।।

আজ বাইশে শ্রাবণ (৭ই আগস্ট ২০২০) - কবির তিরোধান দিবস। সেই ১৯৪১-এ তিরোধানের বছরেই যে তিনি তৈরী করলেন জন্মদিনের গান। কি আশ্চর্য সেখানেও ! সেই গানই যে আক্ষরিক অর্থে হয়ে রইল তাঁর শেষ গান-সৃষ্টি। আচার্য শান্তিদেব ঘোষের অনুরোধে যে গান তৈরী হয়েছিল ২৩শে বৈশাখ, কবির জীবদ্দশায় শেষ জন্মদিনের ঠিক দু'দিন আগে। বিস্ময়ের পর বিস্ময়। 

এই গান তিনি কিছুতেই তৈরী করতে চাননি। প্রৌঢ় বয়সের রবীন্দ্রনাথের সেই চিরাচরিত সঙ্কোচ এবং নিজেকে প্রচারের আলোয় না নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। সেই গল্প দিয়েই শেষ করব আমার এই "বড়ো বিস্ময় জাগে"র পথচলা। সঙ্গে থাকবে আগের পর্বে না বলা চিঠিটির কথা, যেখানে উল্লিখিত সরল স্বীকারোক্তি মানুষ রবীন্দ্রনাথকে পৃথক করেছে বিশ্বের সমস্ত পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের মানুষের কাছে। তাই তিনি বিশ্বজয়ী বিশ্বকবি - আজও রয়ে গেছে তাঁকে নিয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসা, অপার বিস্ময়।

'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-২১/চলবে ..........

'বড়ো বিস্ময় জাগে'র সমাপ্তি পর্ব (২২) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1)robisarani (2)toi

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু