বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-২০) | Baro Bismay Jage Ep#20

বড়ো বিস্ময় জাগে 
পর্ব-২০

রবীন্দ্রনাথের দুষ্প্রাপ্য ছবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন বহুমুখী ও বহুব্যাপ্ত। তাই তাঁর জীবনে বৈচিত্র্যও বড় কম নয়। আঘাতের কয়েকটি অভিঘাত রবিঠাকুরের জীবনে ঠিক কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তা বিগত কয়েকটি পর্বে উল্লেখ করেছি। সেখান থেকে কেমন করেই বা তাঁর মানসিক উত্তরণ ঘটেছে, তাও আলোচনায় এসেছে। শুধু তো আঘাত নয় ! কত প্রাপ্তিও যে তাঁকে এ জীবনে ঋণী করেছিল, তা আমরা অনেকেই জানি। আর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনের উদযাপন-উপাখ্যান কিছুটা আমি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি এর আগে কোন এক পর্বে। 

আয়নায় যখন আলো পড়ে, তার প্রতিফলন ঘটে ঠিক সমান অনুপাতে উল্টো দিকে। কিন্তু এ তো গেল কাঁচের তৈরী আয়না। মনের আয়নায় এই প্রতিবিম্বই আবেগ হয়ে চুরমার করে দেয় কোন আনুপাতিক হিসেব-নিকেশ। তা' আঘাতেই হোক বা উচ্ছ্বাসে। আজ যে দেশে-বিদেশে রবীন্দ্র জন্মোৎসবের এই বিচিত্র সমারোহ, তার সূত্রপাত কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ২৭ বছর বয়েসে। তিনি যখন পঁচাত্তর পূর্ণ করে ছিয়াত্তরে পা দিলেন, সেদিন থেকে (সম্ভবতঃ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) বৈশাখ মাসে দুবার করে তাঁর জন্মদিন পালিত হতে শুরু হল। এর প্রধান কারণ বিশ্বভারতীতে ২৫শে বৈশাখের আগেই গরমের ছুটি পড়ে যেত। তাই নববর্ষের প্রথম দিনটিতেই শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর জন্মদিন উদযাপন শুরু। তিনি লেডি রানু মুখার্জীকে এই নতুন ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারি মজা করে লিখলেন, 'জন্মেছি গরমের দেশে। কবিতা লেখার সময় লিখতে হয়েছে, "সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে" - যত গরমই হোক, কথাগুলো আর ফিরিয়ে নেবার জো নেই' ............. যদিও অন্যত্র লিখছেন, 'গ্রীষ্ম আমার জন্মঋতু, তার বিরুদ্ধে কখনো নালিশ করিনে'। তাঁর মতে 'শীতের মাসগুলো কর্মমাস - যত দায়িত্বের বোঝা কাঁধে এসে চাপে। তাই হয়তো আমার অধিকাংশ কবিতার রচনাকাল গ্রীষ্ম এবং বর্ষা'

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি
সত্তরের জন্মদিনে আবার এক অন্য বিস্ময়। কবি এবার চিত্রকররূপে আত্মপ্রকাশ করছেন। ঊনসত্তর পূর্ণ করে সত্তরে পা দিলেন তিনি এবং সেবার ২৫শে বৈশাখ তিনি প্যারিসে। প্যারিস থেকে ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন, 'বিগত শতাব্দীতে ২৫শে বৈশাখ যে রবিঠাকুর আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁর কবিত্ব এখন আচ্ছন্ন। তিনি এবার চিত্রকর রূপে প্রকাশমান'। ওই সত্তর বছরে পৌঁছে তিনি নিজেকে চিত্রকর হিসেবে প্রকাশিত করেন। তিনি নিজেই লিখছেন, 'ফ্রান্সের মতো কড়া হাকিমের দরবারেও শিরোপা মিলেছে - কিছুমাত্র কার্পণ্য করে নি'।

প্যারিসে ২রা মে ১৯৩০ Galerie Pigalle-তে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্র
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে
প্রদর্শনী হল। ১২৫টি ছবি নিয়ে ওই প্রদর্শনীর সাফল্যের সমস্ত কৃতিত্ব তুলে দিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঝুলিতে। তিনি লিখছেন। 'এখানকার সমস্ত বড়ো বড়ো জ্ঞানীগুণীদের ভিক্টোরিয়া জানে। ও ডাক দিলেই তারা আসে। ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, ছবি ভালোই হোক কিংবা মন্দ, কারো চোখেই পড়ত না'।

ধরণীর বুকে এ যেন আরেক রবীন্দ্রনাথের জন্ম - ৭০ বছরে পদার্পণ করে। এমন প্রাপ্তিতে বিশ্ববাসী তো চমৎকৃত বটেই, রবীন্দ্রনাথ নিজেও এতটাই আপ্লুত যে প্যারিস থেকে নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লিখছেন, 'আমার জন্মভূমি পূর্বে ও পশ্চিমে দ্বিখণ্ডিত। এখানে যে রবীন্দ্রনাথ আছে, তার সঙ্গে দেশের ২৫শে বৈশাখের মিল হবে না - দেশে ফিরলেই তাকে ফিরে পাব। সেখানকার আকাশে-বাতাসে রূপে-রসে এমন কিছু আছে যা আমার মানসখাদ্যের প্রাণপদার্থ। কিন্তু এতো অকিঞ্চিৎকরতার সঙ্গে জড়িত যে সে আত্মমর্যাদা ভুলিয়ে দেয়। এখানকার মানুষ আমাকে গভীর করে সম্পূর্ণ করে উদ্বোধিত করে, তাই নিজেকে শ্রদ্ধা করতে পারি। আসল কথা, আমার বিশ্ব-প্রকৃতি আছে সমুদ্রের ওপারে, আর মানব-প্রকৃতি আছে এপারে। ............ তাই আমার জন্মভূমি পূর্বে ও পশ্চিমে দ্বিখণ্ডিত।

এমন অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর কাছ থেকেই আশা করা যায়। ঠিক তার পরের বছর ১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথের এমন আরেকটি গভীর আবেগপূর্ণ অকপট স্বীকারোক্তি আমরা লিখিত আকারে পাই। কিন্তু তার কথা আজ নয়, তোলা রইল পরের পর্বের জন্যে। 

'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-২০/চলবে ..........

'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (২১) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1)pinterest (2)wikimedia  (3)the week  

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু