একটু ভেবে দেখুন পর্ব ১০ (দূরত্ববিধি) Ektu Bhebe Dekhun Ep#10
একটু ভেবে দেখুন
পর্ব ১০
আজকের পর্ব - দূরত্ববিধি

'বিহেভিয়ারাল সায়েন্স' - এই বিষয়টি আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয়। আজ অতিমারির বন্দিদশায় কেন জানি না মালুম হচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্কে 'বিহেভিয়ারাল সায়েন্স'-এর যে সমীকরণ কাজ করে, তা বোধ হয় লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমার এক বন্ধু বলছিলেন, 'আজকাল খবরের কাগজ পড়তেও যেন ভীতি এসে গেছে। সেই একই ...... কতজন আক্রান্ত, আর মৃত্যুই বা কত ? এরপর স্বামী-স্ত্রীতে অঙ্কের খেলা, বিশ্বে Mortality Rate কি ? ভারত সেখানে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে ? আমার চেতনা বলে, আমাদের মনে বোধ হয় একটু বেশিই ভয় ঢুকে পড়েছে। আজ থেকে কয়েক মাস আগেও, ঘরের অভ্যন্তরে একেবারে নির্বান্ধব বন্দি-জীবনে আমরা কেউই অভ্যস্ত ছিলাম না। অথচ, আজ বিশেষ প্রয়োজনেও অতি কাছের মানুষকে ঘরে ঢোকবার অনুমতি দিতে সংকোচ বোধ করছি। উল্টোদিকে, সেই কাছের মানুষটিও অতি-সাবধানী হতে গিয়ে তাঁর খোলা মনের উৎসাহী ব্যবহারেও যতি টেনে দিচ্ছেন। দূরত্ব বাড়ছে আপনা হতে। আমাদের অনুভূতিগুলোও ম্রিয়মান হয়ে পড়ছে অব্যবহারে। নইলে প্রতিবেশীর নিছক জ্বর হওয়ার সংবাদেই তাকে গ্রহণযোগ্যতার ত্রিসীমানার ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছি কেন পত্রপাঠ ? এমন দৃষ্টান্ত তো চোখের সামনে উঠে আসছে বারবার। এর ফল কি হতে পারে ?
নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী-জনসংযোগকারীদের প্রবল তৎপরতা সত্ত্বেও সংক্রমণে আক্রান্তদের অতি শীঘ্র কেয়ার ইউনিট-এ নিয়ে যেতে পারছি না। আঞ্চলিক মিউনিসিপাল অফিস থেকে বাকিদের সুরক্ষিত রাখতে আক্রান্তের বাড়িতে স্যানিটাইজ করতে আসছে দীর্ঘ টাল-বাহানার পর। কারণ এই কাজে এক অপরিসীম ভয়। এই ভয়ের গ্রাসে করোনা আক্রান্তের খবরের সত্যতা বিচার না করেই অসুস্থকে একেবারে নির্বাসিত করছি নিজের বলয়ের মধ্যে থেকে। এই সমস্ত কিছুর প্রতিফলন ঘটছে এমনভাবে এবং এতো দ্রুত যে এর পর হয়তো দেখা যাবে, পাশের ফ্ল্যাটে অন্য কোন এমার্জেন্সিতেও আমরা নিজেদের দরজা খুলব না। আর আমরা - আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে যদি Covid Positive ধরা পড়ে - ক্রমশঃ তা লুকোতে শুরু করব প্রতিবেশীর কাছে। তাতে সংক্রমণ বাড়বে না কমবে ? বাইরে থেকে তো এ রোগে বোঝা সম্ভব নয়, কে আক্রান্ত আর কে নয় ?

এমন দূরত্ব কি আমরা সত্যিই কামনা করি ? যদি পাশের বাড়ির একলা থাকা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা সংক্রমিত হন, এই দূরত্ববিধিতে তো তার অসুস্থতার সংবাদও আমরা পাবো না। সেটা কি আদৌ বাঞ্ছনীয় ? এই সমাজে আমরা কি একে অপরের পরিপূরক নই ?
একটু হলেও উপলব্ধি করছি রোজকার নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার অভাব। যারা প্রতিদিন রাস্তা সাফাই করে, বাড়ি বাড়ি এসে আবর্জনা নিয়ে যায় - তাদের বাঁশির ডাকের অভাব। বাড়ির প্রতিদিনের রান্নার লোক, ঠিকে-কাজের লোকের কল-কোলাহলের মধ্যে দিয়ে আমাদের অভাবনীয় সাহায্য করবার লোকের অভাব। আমার পাড়ার 'ওমপ্রকাশ' ছেলেটি বিনা ছুটিতে নিয়মিত তার কাজ করে যাচ্ছিল, তাকে সকালে দেখতে পাওয়াটা প্রতিদিনের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছিল। নীল-সবুজ বালতির হৃদয় নিংড়ে আবর্জনা পরিষ্কার করা ছিল তার সরকারি চাকরি। ক'দিন তাকে দেখছি না। অভ্যাসের চোখ কৌতূহলী হয়। তার পরিবর্তকে জিজ্ঞেস করতে জানলাম, ওমপ্রকাশ রাস্তায় কাজ করতে করতে এক দুপুরের প্রখর রোদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এখন হাসপাতালে জীবন-মরণে লড়াই চলছে। কি করতে পারি ? শুধু 'আহা' বলা ছাড়া ! যে আশ্বাস-বাণী বাস্তবে ওই ছেলেটির কানে গিয়ে পৌঁছবার আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই !
আমাদের এই ভয়-ভীতির চতুষ্কোণের মধ্যে ডাক্তারসহ যারা জনগণের সেবা করে চলেছেন, তারা তো এই মুহূর্তে আমাদের পরিত্রাতা! অতিমারির এই রোগ বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন যে অর্থবলের কোন মূল্যই তার কাছে যথেষ্ট নয়। তাই সাধারণের মধ্যে কারোর অস্বাভাবিক নির্ভয়, গৃহবন্দি কারোর মনে অতিরিক্ত ভয় - এই দুই নিয়েই যত সংশয়। মুদ্রার যেমন উল্টো পিঠ থাকে, সব বক্তব্যেরই একটা দ্বিতীয় ইন্টারপ্রিটেশন হয়। তবু, অসাবধানী নতুবা অতি সাবধানী - অন্যের ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনা তুঙ্গে।
কিন্তু যেদিন নিজের ঘরে ডাকাত পড়বে, সেদিন আমরা কি করব ? সাবধানী আমাদের হতেই হবে - আরেকটু সচেতন হওয়াও কি জরুরি নয় ? অন্তত নিজের পরিমণ্ডলটুকুতে ? ওই পরিমণ্ডলেই আমাদের পরিবেশ - তাকে সবুজ রাখাটাও আমাদেরই কর্তব্য। মিডিয়াতে শুধু এইটা করা উচিত, এটা হচ্ছে না, ওটা হলে আরো ভালো হতো ................ অন্যের সমালোচনার উর্দ্ধে উঠে আসুন আমরা সকলে মিলে এই লড়াইয়ে এক হই। অসুস্থকে ব্রাত্য করে না দিয়ে তার পাশে দাঁড়াই। ঠিক যেটুকু উপস্থিতিতে বিপদে পড়া মানুষের সাহস বাড়ে, আত্ম-বিশ্বাস জাগ্রত হয়। এই ঐক্যই হয়ে উঠবে আজকের সময়ের 'ভ্যাকসিন'।
কোন অপেক্ষা নয়, ভয় নয়, ভরসায় বাঁচুক পৃথিবী।
একটু ভেবে দেখবেন !
"একটু ভেবে দেখুন"-এর বাকি পর্ব পড়তে চাইলে নিচে দেওয়া লিংক-এ ক্লিক করুন ।
image courtesy : (1)celeb'sword (2)AZbigmedia
Comments
Post a Comment