বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১৭) | Baro Bismay Jage Ep#17

বড়ো বিস্ময় জাগে 
পর্ব-১৭

আমার কাছে সম্পূর্ণ ঠাকুরপরিবারই বিস্ময়সৃষ্টির এক আঁতুড়ঘর। 

রবিজীবন তখনও পনেরো পেরোয় নি। আজ বলব সেই বাল্য বয়সেই এক চরম আঘাত পাবার ঘটনার কথা। চলমান জীবনের কোন কোন বিশেষ অবস্থানে আমরা এমন নিবিড় করে কখনো কাউকে কাছে পাই, যে তাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারি না বা তার বর্তমান থেকে অতীত হতে যাবার বাস্তবতাকে সহ্য করবার অনুকূল মানসিক দৃঢ়তা থাকে না। জীবনের চতুর্দশ বছরে মা'য়ের আকস্মিক প্রয়াণ বিহ্বল বালক রবির জীবনে তেমনি এক চরম বিপর্যয়। মৃত্যুর ব্যাখ্যা তখনও অধরা বালকের মনে। সঙ্গী তাকেই বলা চলে যে মানসিকতার দুর্বল বা সবল - দুই মুহূর্তেই জীবনে বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। সেই বিপর্যয়ে মায়ের অভাবপূরণে রবীন্দ্রনাথের 'নতুন বৌঠান' এমনই একজন চরিত্র, যে তার যাবতীয় অন্তর-সৌন্দর্যে ও শৈল্পিক কৌলিন্যে বালক রবির উত্তরণের পথে অনিন্দ্যসুন্দর পটভূমি রচনা করলেন। 

মাধুরীলতা ও রথীকে সঙ্গে নিয়ে
ছেলেবেলায় আমাদের মধ্যে অনেকেরই কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় 'জল পড়ে পাতা নড়ে'র মাধ্যমে। সাধারণের সাথে অ-সাধারণের তফাৎ এই যে, সাধারণে শব্দের বানান, উচ্চারণে স্পষ্টতা, স্মৃতির প্রখরতা, কম-দাঁড়ির সঠিক প্রয়োগ নিয়েই ব্যাকুল থাকে। আর অ-সাধারণের মনের ভেলায় জল পড়বার ফলে স্নিগ্ধ সজীব পাতা ঝংকার তোলে। ছেলেবেলায় বালক রবির চৈতন্যের মধ্যে যে 'জল পড়া ও পাতা নড়া' শুরু হয়েছিল, তার রেশ বুঝি সারাজীবনই রয়ে গেল। কেবল কয়েকটি দুঃসময় যেন সময়-ঘড়ির কাঁটাকে স্তব্ধ করে কবিকে স্থবির করে দিয়েছিল। তবে তা সাময়িক - এক অতীন্দ্রিয় সত্যের সন্ধান পাওয়া ঋষিতুল্য রবীন্দ্রনাথ নতুন শক্তি সঞ্চয় করে নতুন করে সৃষ্টির পথে বিলাস করেছেন - এও এক আশ্চর্য ! ৮০ বছরের দীর্ঘ জীবন এমনই এক প্রশান্ত মহাসাগর - ডুব দিলে আর উঠে আসা অসম্ভব - এই রূপসাগরে ডুব দিলে অরূপরতন আশা করতে হয় না - আপনিই সে ধরা দেয়। 

চারমাসের হিমালয় ভ্রমণ পর্ব সেরে বালক রবি বাড়ি ফিরে মায়ের ঘরের সভায় খুব একটা বড়ো আসন দখল করে বসলেন। বাড়ির বয়ঃকনিষ্ঠা বধূ, রবীন্দ্রনাথের কিছু বড় - তাঁর কাছে কনিষ্ঠ দেবরটি প্রচুর স্নেহ ও আদর পেলেন। ইনিই জ্যোতিদাদার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী - রবির নতুন বৌঠান। জ্যোতিদাদা ও কাদম্বরী দেবী নিঃসন্তান। তাঁদের কাছেই রবীন্দ্রনাথের যতো কিছু আদর-আবদার। তরুণ কবির ভাবের সাধনায় তাঁরাই ছিলেন অনুকূল সঙ্গী।

কাদম্বরী দেবী
কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথকে যে কতটা স্নেহ করতেন এবং রবীন্দ্রনাথও যে বৌঠানকে কোন আসনে বসিয়েছিলেন, তা 'মৈত্রেয়ী দেবী'র একটি লেখায় স্পষ্ট ধরা পড়ে - 'বিস্মিত হয়ে ভাবি, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের পরেও যে স্নেহের স্মৃতি এমন ওতপ্রোতভাবে তাঁর জীবনে জড়িয়ে ছিল, তাঁর কল্পনায় মাধুর্য বিস্তার করত, অসংখ্য কবিত্বের কেন্দ্র হতো, সে না জানি কি প্রভাবমন্ডিত ছিল ! এমন অভূতপূর্ব বিরাট প্রতিভার মধ্যে এতো গভীর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব যিনি বিস্তার করতে পারেন, না জানি তিনিও কতটা প্রতিভাময়ী'। কাদম্বরী দেবীর উল্লেখযোগ্য কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি, সাহিত্য-সংগীতে অনুরাগ ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা তাকে ঠাকুরবাড়িতে এক বিশেষ জায়গা দিয়েছিল - সে প্রমাণ পাওয়া যায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে চোখ রাখলেই। 

অলস দুপুরে যখন জ্যোতিদাদা ব্যস্ত থাকতেন জমিদারির তদারকিতে, তখন রবীন্দ্রনাথের নতুন কবিতা-গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা ও সমালোচক 'নতুন বৌঠান' সেই সৃষ্টিতে রামধনু এঁকে দিয়ে যেতেন। মাত্র দু বছরের বড় এই সঙ্গীটির উপরেই দায়িত্ত্ব এসে পড়ল এই বালক রবির দেখাশোনা করবার, যখন অকালে চলে গেলেন তাঁর মা সারদা দেবী। সেটা ১৮৭৫ সাল - রবির বয়স তখন ১৪ বছরেরও কম। হৃদয়-আসনে কখন কোন বসন্তের হাওয়া দোল দিয়ে যায় - তা অন্তর্যামীই জানেন! কিন্তু বহিঃপ্রকাশ যখন লেখনীর মাধ্যমে প্রতিভাত হয়, তখন সেখানে এভারেস্ট শৃঙ্গের তুষার-মুকুট দৃষ্টিগোচর হয় - নতুন সূর্য যেখানে চোখ মেলেছে। বালক রবির সৃষ্টির পথে পা ফেলার প্রথম মুহূর্ত থেকে নতুন বৌঠান এমন এক অস্তিত্ব যে তার রেশ থেকে কবি আর বেরোতে পারেন নি। তার উচ্চারিত প্রমাণ রয়ে গিয়েছে গল্পে-কবিতায়-গানে অসংখ্যবার। 


ভগ্নহৃদয় - প্রচ্ছদ
'ভগ্ন-হৃদয়' গীতিকাব্য এমনিই এক সৃজন। সে যুগে কাব্যে উৎসাহী অনেক যুবক এই কাব্যের বহু অংশ মুখস্থ বলতেন। প্রসঙ্গতঃ 'ভগ্ন-হৃদয়' বেনামে উৎসর্গ করেছিলেন কাদম্বরী দেবীকে। সুদূর ত্রিপুরা থেকে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য দূত পাঠিয়েছিলেন শুধু এটুকু জানাতে যে 'ভগ্ন-হৃদয়' পড়ে তিনি অত্যন্ত প্রীত হয়েছেন। আশ্চর্য ! তরুণ কবির আশাতীত পুরস্কার ! আমরা জানি সত্যজিৎ রায়ের 'চারুলতা' রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়' উপন্যাসের অবলম্বনে তৈরী ছায়াছবি। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাসে যে গল্পের কথামালা এই দুই একাত্ম মনের আত্মকথা। 

কবি ভালোবাসতেন বর্ষা ঋতু, অত্যন্ত প্রিয় ছিল বসন্তের কাল, কিন্তু বসন্তের হাওয়ায় পাতাও তো ঝরে পড়ে ? রবীন্দ্রনাথের কলকল বয়ে চলা উচ্ছল জীবনের গতিকে হঠাৎই করে স্তব্ধ করে দিয়ে গেল কাদম্বরী দেবী অকস্মাৎ আত্মহনন। কড়া ডোজের আফিম খেয়ে নিজেই জীবনের গতির রথ থামিয়ে দিলেন রবির প্রাণের চেয়েও প্রিয় নতুন বৌঠান। শোনা যায়, মহর্ষি  চাননি এই পারিবারিক দুর্ঘটনার কথা ঠাকুরবাড়ির বাইরে প্রচারিত হোক। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু যে দিনটিতে ঘটে, ঠিক সেই সন্ধ্যায় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ খানাপিনাসহ একটি সাংবাদিক বৈঠক আয়োজন করেন। যার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল, কলকাতার বিশিষ্ট সংবাদমাধ্যমে যাতে ওই দুর্ঘটনার কোন বিশেষ প্রতিবেদন না থাকে। শ্রীমতি বন্দনা মুখোপাধ্যায় একটি ছবি তৈরী করেছিলেন, যার নাম ছিল 'চিরসখা হে'। এই ছবিটি ২০০৭ সাল-এ নিউ ইয়র্ক শহরে প্রিমিয়ার হয় এবং ছবির বিষয়বস্তু আয়নার উল্টোপিঠ - কাদম্বরী দেবীর চোখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখা। পরিচালিকা নিজে এবং ছবির মুখ্য চরিত্রেরা এই বিষয়ের উপরে গভীর গবেষণা করেন, নিজেদেরই আগ্রহে - সেখানেই উঠে আসে ওপরে বর্ণিত ঘটনাটির মতো বেশ কিছু নতুন তথ্য। 

পরানসখা 'নতুন বৌঠানের' এই হঠাৎ মৃত্যু সইতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথ, সে গল্প আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তার পরবর্তী পর্যায়ে এই মর্মবেদনা কিভাবে ছাপ ফেলেছিল কবির জীবনে ? তার আলোচনা তোলা রইল, পরবর্তী কোন পর্বে আলোচনা করব। আজ এই পর্যন্তই।

'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৭/চলবে ..........

'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (১৮) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র ১ম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 

©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1) (2) pinterest (3) telegraph

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু