বড়ো বিস্ময় জাগে (পর্ব-১৭) | Baro Bismay Jage Ep#17
বড়ো বিস্ময় জাগে
পর্ব-১৭
আমার কাছে সম্পূর্ণ ঠাকুরপরিবারই বিস্ময়সৃষ্টির এক আঁতুড়ঘর।
রবিজীবন তখনও পনেরো পেরোয় নি। আজ বলব সেই বাল্য বয়সেই এক চরম আঘাত পাবার ঘটনার কথা। চলমান জীবনের কোন কোন বিশেষ অবস্থানে আমরা এমন নিবিড় করে কখনো কাউকে কাছে পাই, যে তাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারি না বা তার বর্তমান থেকে অতীত হতে যাবার বাস্তবতাকে সহ্য করবার অনুকূল মানসিক দৃঢ়তা থাকে না। জীবনের চতুর্দশ বছরে মা'য়ের আকস্মিক প্রয়াণ বিহ্বল বালক রবির জীবনে তেমনি এক চরম বিপর্যয়। মৃত্যুর ব্যাখ্যা তখনও অধরা বালকের মনে। সঙ্গী তাকেই বলা চলে যে মানসিকতার দুর্বল বা সবল - দুই মুহূর্তেই জীবনে বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। সেই বিপর্যয়ে মায়ের অভাবপূরণে রবীন্দ্রনাথের 'নতুন বৌঠান' এমনই একজন চরিত্র, যে তার যাবতীয় অন্তর-সৌন্দর্যে ও শৈল্পিক কৌলিন্যে বালক রবির উত্তরণের পথে অনিন্দ্যসুন্দর পটভূমি রচনা করলেন।
![]() |
মাধুরীলতা ও রথীকে সঙ্গে নিয়ে |
চারমাসের হিমালয় ভ্রমণ পর্ব সেরে বালক রবি বাড়ি ফিরে মায়ের ঘরের সভায় খুব একটা বড়ো আসন দখল করে বসলেন। বাড়ির বয়ঃকনিষ্ঠা বধূ, রবীন্দ্রনাথের কিছু বড় - তাঁর কাছে কনিষ্ঠ দেবরটি প্রচুর স্নেহ ও আদর পেলেন। ইনিই জ্যোতিদাদার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী - রবির নতুন বৌঠান। জ্যোতিদাদা ও কাদম্বরী দেবী নিঃসন্তান। তাঁদের কাছেই রবীন্দ্রনাথের যতো কিছু আদর-আবদার। তরুণ কবির ভাবের সাধনায় তাঁরাই ছিলেন অনুকূল সঙ্গী।
![]() |
কাদম্বরী দেবী |
অলস দুপুরে যখন জ্যোতিদাদা ব্যস্ত থাকতেন জমিদারির তদারকিতে, তখন রবীন্দ্রনাথের নতুন কবিতা-গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা ও সমালোচক 'নতুন বৌঠান' সেই সৃষ্টিতে রামধনু এঁকে দিয়ে যেতেন। মাত্র দু বছরের বড় এই সঙ্গীটির উপরেই দায়িত্ত্ব এসে পড়ল এই বালক রবির দেখাশোনা করবার, যখন অকালে চলে গেলেন তাঁর মা সারদা দেবী। সেটা ১৮৭৫ সাল - রবির বয়স তখন ১৪ বছরেরও কম। হৃদয়-আসনে কখন কোন বসন্তের হাওয়া দোল দিয়ে যায় - তা অন্তর্যামীই জানেন! কিন্তু বহিঃপ্রকাশ যখন লেখনীর মাধ্যমে প্রতিভাত হয়, তখন সেখানে এভারেস্ট শৃঙ্গের তুষার-মুকুট দৃষ্টিগোচর হয় - নতুন সূর্য যেখানে চোখ মেলেছে। বালক রবির সৃষ্টির পথে পা ফেলার প্রথম মুহূর্ত থেকে নতুন বৌঠান এমন এক অস্তিত্ব যে তার রেশ থেকে কবি আর বেরোতে পারেন নি। তার উচ্চারিত প্রমাণ রয়ে গিয়েছে গল্পে-কবিতায়-গানে অসংখ্যবার।
![]() |
ভগ্নহৃদয় - প্রচ্ছদ |
কবি ভালোবাসতেন বর্ষা ঋতু, অত্যন্ত প্রিয় ছিল বসন্তের কাল, কিন্তু বসন্তের হাওয়ায় পাতাও তো ঝরে পড়ে ? রবীন্দ্রনাথের কলকল বয়ে চলা উচ্ছল জীবনের গতিকে হঠাৎই করে স্তব্ধ করে দিয়ে গেল কাদম্বরী দেবী অকস্মাৎ আত্মহনন। কড়া ডোজের আফিম খেয়ে নিজেই জীবনের গতির রথ থামিয়ে দিলেন রবির প্রাণের চেয়েও প্রিয় নতুন বৌঠান। শোনা যায়, মহর্ষি চাননি এই পারিবারিক দুর্ঘটনার কথা ঠাকুরবাড়ির বাইরে প্রচারিত হোক। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু যে দিনটিতে ঘটে, ঠিক সেই সন্ধ্যায় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ খানাপিনাসহ একটি সাংবাদিক বৈঠক আয়োজন করেন। যার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল, কলকাতার বিশিষ্ট সংবাদমাধ্যমে যাতে ওই দুর্ঘটনার কোন বিশেষ প্রতিবেদন না থাকে। শ্রীমতি বন্দনা মুখোপাধ্যায় একটি ছবি তৈরী করেছিলেন, যার নাম ছিল 'চিরসখা হে'। এই ছবিটি ২০০৭ সাল-এ নিউ ইয়র্ক শহরে প্রিমিয়ার হয় এবং ছবির বিষয়বস্তু আয়নার উল্টোপিঠ - কাদম্বরী দেবীর চোখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখা। পরিচালিকা নিজে এবং ছবির মুখ্য চরিত্রেরা এই বিষয়ের উপরে গভীর গবেষণা করেন, নিজেদেরই আগ্রহে - সেখানেই উঠে আসে ওপরে বর্ণিত ঘটনাটির মতো বেশ কিছু নতুন তথ্য।
পরানসখা 'নতুন বৌঠানের' এই হঠাৎ মৃত্যু সইতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথ, সে গল্প আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তার পরবর্তী পর্যায়ে এই মর্মবেদনা কিভাবে ছাপ ফেলেছিল কবির জীবনে ? তার আলোচনা তোলা রইল, পরবর্তী কোন পর্বে আলোচনা করব। আজ এই পর্যন্তই।
'বড়ো বিস্ময় জাগে'/তপন বসু/পৃষ্ঠা-১৭/চলবে ..........
'বড়ো বিস্ময় জাগে'র পরের পর্ব (১৮) পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
©tapan basu. all rights reserved.
Image Courtesy >(1) (2) pinterest (3) telegraph
Comments
Post a Comment