মনে পড়ে-৭ | সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় | Mone Pore Ep#7

 মনে পড়ে-৭

কিংবদন্তী অভিনেতা-নাট্যপরিচালক-কবি ও আবৃত্তিকার শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।।

ইহজগতে কিছু মানুষ যে সরণশীল ও মরণশীল - এ সত্য বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে না। এঁরা অনেকটা নদীর জলের মতো - বাসি টাটকা বলে কিছু নেই, গড়িয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত - সুজলা বাষ্পে সুফলা ধরণীকে এগোবার মন্ত্র শুনিয়ে। আমাদের যেমন মা ও বাবা - এনারা কোন এক সময়ে যে আমাদের জীবনের গন্ডি থেকে সরে যেতে পারেন বা স্মরণপথের পথিক হতে পারেন, তা কি আমরা মানতে পারি ? তবু, জাগতিক নিয়মে আমাদের পথ দেখানো এই ইহ-জীবনেরা এ কূল ছেড়ে অন্য কূলে পাড়ি জমান - আমরা একা হই।  

সৌমিত্রদা আমাদের অভিবাবক-স্বরূপ তেমনই এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি কর্মহীন জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন না। কাজই তাঁকে অমর করেছে - আর তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন সংস্কৃতির সকল মঞ্চে সকল কাজের কাজী হিসেবে। আমরা অভ্যস্ত হয়েছি এই শক্ত স্তম্ভটিকে ধরে পথ চলতে। তাই, অনেকের মতো আমিও কখনও ভাবিনি যে এই স্তম্ভটিও ক্ষয়িষ্ণু - তারও বয়স বাড়ছে। ভাবিনি, তিনি কখনো বলতে পারেন 'আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়'।


রবীন্দ্রভাবনায় অনুপ্রাণিত
"উত্তরকাল" শীর্ষক এলবামের জন্যে আমার একটি ভাষ্যরচনা, লেখা হয়ে পড়ে ছিল বেশ ক'দিন। বলছি ২০১৯-এর কথা। বাসনা ছিল, সৌমিত্রদার স্বর্ণ-কণ্ঠ যদি এ লেখায় জাদুর কাঠি বুলিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু ওই ! তাড়া না এলে কিছু কিছু অনুভব যে ভাষা পায় না ! অনুচ্চারিত থাকতে থাকতে সে ধুলোর প্রলেপে চাপা পড়ে যায় - আড়াল থেকে অন্ধকারে 

না, এবার কিন্তু খুব বেশিদিন পড়ে রইল না। তাড়া দিলেন এই এলবামের কণ্ঠশিল্পী - আগরতলা নিবাসী এই শিল্পী জীবনের প্রথম অ্যালবাম করছেন -  তাই তার তাগিদ বেশি ও উচ্চারিত। ধুলো পড়বার আগেই তাই লেখা নিয়ে পৌঁছলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সময় তিনিই বলে দিয়েছিলেন। নিয়ম-কানুন জানা ছিল, তাই এবারে প্রথম দিনেই সঙ্গে রেখেছিলাম আমার স্ক্রিপ্টের খসড়া লেখা খাতা। এবারে আর পরীক্ষা দিতে হলো না। তবু যেহেতু নতুন শিল্পী, তাই একটু খবরাখবর নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন কেমন গান করেন, রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করে কিনা ইত্যাদি। জানতে চাইলেন - 'কবে রেকর্ড করতে চাও ? এই বছর তো শেষ হতে চলল। সামনের বছর গোড়ার দিকে আমরা কাজটা করি' ?

আমাদের প্রত্যেকের মনের অন্দরমহলে রূপকথার এক একটা মহাকাব্য থাকে। তার নানা রূপ সময়ে অসময়ে কথা হয়ে বের হয়। আমার কথা ফুটল অন্দরমহল থেকে কারোর তাড়নায়। 'অন্তরে জাগিছ অন্তর্যামী' .........

- 'দাদা ! আপনি সময় দিলে একটু তাড়াতাড়ি রেকর্ডটা করতে চাই'।
- দাদা সময় দিলেন ২৩শে ডিসেম্বর ২০১৯। বললেন, 'তুমিই এসে আমাকে নিয়ে যেও। রাজীবকে বলে রেখো, আমি ওর ওই Film Service Studio-তেই রেকর্ড করব'।

"উত্তরকাল" নামক এই ভাষ্যরচনায় আমি চেষ্টা করেছিলাম আমাদের সাংস্কৃতিক কর্তব্য সম্পর্কে নিজেদের কাছেই এক প্রশ্ন তুলে ধরতে। উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছি, তার প্রকৃত মর্যাদা কি আজ আমরা দিতে পারছি ? অতীতকে আঁকড়ে থাকার প্রয়োজন না থাকতে পারে এ যুগে, কিন্তু তাকে জানা তো দরকার। নইলে তার শরীরও যে সংগ্রহশালার কাঁচের আলমারিতে দ্রষ্টব্য হয়ে জমা পড়বে ! অ-দর্শনের আগুনে যেন না পোড়ে আমাদের প্রাপ্ত অধিকার - এই ছিল আমার বিষয়বস্তু। উঠে এসেছিল নানা মনীষীর ঋদ্ধ বিশ্লেষণ। মনে আছে, এক-একটি গানের প্রসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা বিশ্লেষণগুলো উঠে আসছে, আর স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে সৌমিত্রদা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন ও বলছেন, 'কি সুন্দর বললেন লীলা মজুমদার এই কথাটা, তাই না !  কি অপূর্ব ওই কারাগারে বন্দি আসামী'র জবানবন্দি ! যিনি বলছেন, 'স্বাধীনতার জন্যে এতো লড়াই করে আমার কি হলো ? আমরা কি পেলাম'? কিন্তু তাঁর সেই দ্বিধা দূর হয়ে যাচ্ছে রবিঠাকুরের "দুঃসময়" কবিতাটি পড়ে। এই স্ক্রিপ্টটা লিখতে লিখতে আমি বহুবার থেমেছি, বলা যায় থামতে বাধ্য হয়েছি। রবীন্দ্র-দর্শনের গভীরতাই আমাকে বারে বারে নতুন দৃষ্টি দিয়েছে, আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে ! যতোটা অনুভবে থেমেছি, ততটাই হৃদয়ে এগিয়েছি। 

কিন্তু 'আমি' কে ? যেখানে সৌমিত্রদাকে চোখের সামনে দেখছি শিশুর মতো উৎসাহিত হতে, একাত্ম হতে ! ভাষ্যপাঠ সম্পূর্ণ হ'লে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তপন, তুমি যেভাবে চেয়েছ, আমি তেমন বলতে পেরেছি তো'? 

বাকরুদ্ধ-বিস্মিত আমরা ষ্টুডিও'র সবাই। আমি অস্ফুট .....
না........ সৌমিত্রদা না, আপনি পারেন নি। আমরা চেয়েছিলাম, আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না। 

এই আমি, যে আপনাকে সামনে রেখে আধুনিক সিনেমা দেখতে যেত! আপনার কণ্ঠ কানে নিয়ে গীতাঞ্জলি পড়ত। এখন তো মোমবাতির শরীরটুকু স্মৃতি হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে ! সেখানে আলো কই ?

কানে ভাসছে সেদিন রেকর্ড হয়ে থাকা আপনার কথা, 'আমার যা করবার, তা আমি করেছি। কি হবে আর কি না হবে, তা তো আমার ভাববার কথা নয়' !

কিন্তু আমরা তো ভাবছি.......
ভাবছি আর অনুধাবন করবার চেষ্টা করছি, শ্রোতাদের কাছে এই "উত্তরকাল" অডিও ও ভিডিও সিডি যে আপনার কণ্ঠনিঃসৃত সর্বশেষ সম্পূর্ণ অ্যালবাম !

আপনার সেই দেবকন্ঠ, সংস্কৃতির নন্দন-সুষমায় ভরা অনুভূতি - সে কি আজ স্বপ্ন, না সত্যি ! আপনার সর্বশেষ এলবামের ভাষ্য-লেখক, প্রকাশক হিসেবে সঙ্গী হয়ে থাকাটা কি সৌভাগ্যের না দুর্ভাগ্যের ?

উত্তরকালের হাতেই তোলা থাকুক সে প্রশ্ন আর তার উত্তর।

সমাপ্ত 

© tapanbasu. all rights reserved.
photo courtesy : own library 

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু