মনে পড়ে-৬ | সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় | Mone Pore Ep#6
মনে পড়ে-৬
কিংবদন্তী অভিনেতা-নাট্যপরিচালক-কবি ও আবৃত্তিকার শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।।
হঠাৎ মাথায় এলো, রবিঠাকুর তো প্রকৃতির কবি। প্রকৃতিকে তিনি কত রকম ভাবে দেখেছেন, তাঁর মায়াবী কলমের সুদক্ষ জাদুতে তুলে ধরেছেন প্রকৃতির বিচিত্র রূপ। মনে হলো, লিখে ফেলি তাঁর চোখ দিয়ে প্রকৃতির উদ্দেশে এক খোলা চিঠি। বেশ খানিকটা সময় গেল ভাবতে, তারপর লিখতে। লেখা নয় হলো, কিন্তু পড়বেন কে? খুব ইচ্ছে করছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এই ভাষ্যপাঠের জন্যে অনুরোধ করতে। টেলিভশন ও মঞ্চে তাঁকে নিয়ে বেশ কয়েকটি কাজ করবার সৌভাগ্য হলেও, আমার লেখা কোন স্ক্রিপ্টে তিনি ভাষ্য-পাঠ করবেন - এমন ভাবনা মাথায় আসে নি, সুযোগও ঘটে নি। সামান্য একটু পরিচিতি হয়েছে তখন আমার, তাই দ্বিধা কাজ করছে যে তাঁর মতো মাপের শিল্পীর আমার ভাবনা, আমার লেখা যদি পছন্দ না হয়? বড় অভিমানে লাগবে যে ! এ অভিমান সইবার ক্ষমতা কি আমার আছে?

বললেন, 'কি করতে চাও'?
আমার ভাবনা ও পরিকল্পনা ওনাকে বেশ গুছিয়ে ব্যক্ত করলাম, উনি আরো গুরুত্ব সহকারে শুনলেন। তাঁর চোখ-মুখের ভাষা অনুভব করে আমার মনে হলো - আমি পাশ করেছি।
আমার বলা শেষ হলে উনি খুব শান্ত স্বরে আমাকে বললেন, 'তপন, তোমার এই প্রজেক্ট-এ ভাবনাটা সত্যিই সুন্দর। প্রকৃতিকে নিয়ে ঠিক এমন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা কোন স্ক্রিপ্টে আমি এখনো পর্যন্ত কন্ঠ মেলাই নি। তবে তুমি যদি প্রকৃতি সম্পর্কিত তাঁর নিজস্ব লেখাগুলি এবং ছিন্নপত্র বা অন্যান্য পত্রাবলীতে লেখা চিঠিপত্র থেকে উদ্ধৃত করে তোমার ভাবনার বিষয়কে তুলে ধরো, তাহলে কাজটা খুব orthodox হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে orthodox কাজ করাই ভাল, তাই নয় কি' ? - এ কথা বলে উনি আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
আমি কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে কথা হারালাম। এ আমি কি করেছি ? সত্যিই তো ! রবিঠাকুরের সৃষ্টির সাম্রাজ্যে আমি নতুন করে কি নৈবেদ্য সাজাতে পারি ? অণুবীক্ষণের নিচে ভাইরাসটাকে চিনলাম; বুঝলাম - ভুল করেছি।
জিহ্বার নিচে থেকে জল ধার করে গলা ভেজালাম। বললাম, 'দাদা, আমি যে শব্দ-চয়ন করেছি আমার এই "প্রিয়তমাসু"র স্ক্রিপ্ট-এ, সেখানে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ওপরে কোথাও কলম চালাই নি। সেই ক্ষমতাও আমার নেই দাদা, আর সেই ধৃষ্টতাও যেন কখনো দেখাবার সাহস না করি। তাই.'.........
আমার মন বলে, Orthodox কাজে তো রবীন্দ্র-অনুরাগীর আর কিছুই করবার থাকে না, শুধু গান বুঝে তাঁর লেখা জুড়ে দেওয়া ছাড়া। তা করতে যে আমার কেমন যেন মন চায় না। যেটুকু সামান্য রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েছি, তাতে লক্ষ্য করেছি যে তাঁরই নানান লেখা, কবিতা আর গানের কোলাজ তৈরী করে এমন কাজ প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে - ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। তবু আজও তো তাঁকে নিয়ে রসিকজনের গবেষণার অন্ত নেই ! কেন ? কি খুঁজে পেতে চান তাঁরা'? -একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
নীরবতা ভেঙে সৌমিত্রদা বললেন, 'তুমি একটা কাজ করো। কালকে কাউকে দিয়ে সকাল দশটার মধ্যে তোমার স্ক্রিপ্ট-এর একটা টাইপ কপি আমাকে পৌঁছে দাও। আমি পড়ে দেখি। কাল আমার শুটিং নেই, পড়তে সময় পাব। আর হ্যাঁ, টাইপের অক্ষরগুলো যেন একটু বড় হয়'।
ডুবন্ত জীবন খড়কুটো পেলে যেমন বাঁচবার স্বপ্ন দেখে, আমার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নে আমিও তেমন একটা জমি পেলাম মনে হলো। পরদিন পৌঁছে দেওয়া গেল সেই স্ক্রিপ্ট। অন্বেষাকে বললাম, 'দিন সাতেক দেখি আমরা ! তারপর না হয় একবার দাদাকে ফোন করব। স্ক্রিপ্ট যদি ওনার পছন্দ না হয় তাহলে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানেই ডালি সাজানো হবে এবারের অ্যালবামে - কোন ভাষ্যপাঠ আর থাকবে না'।
এটা ২০১৪ সালের কথা বলছি। মনে আছে, যেদিন সকালে ওনাকে স্ক্রিপ্ট পৌঁছে দেওয়া হলো, সেদিন আমার শুটিং ছিল। বিকেলের দিকে যখন চায়ের ব্রেক চলছে, সৌমিত্রদার ফোন। 'তপন, কবে রেকর্ড করতে চাও'?
বিস্মিত হতবাক আমার আবার জলের প্রয়োজন হলো। ঢোঁক গিলে বললাম, 'আপনি পড়বেন '?
উদাস ভিতর-মন বুঝতে শেখালো, 'ঋদ্ধ জ্ঞানীর সুগভীর রবীন্দ্র-চেতনা, নতুনের অভিলাষকে গ্রহণ করবার উদারতা পরবর্তী প্রজন্মে কারিগরদের এক স্বপ্ন দেখিয়ে যায়। যে স্বপ্ন আত্ম-বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। সংগীতের ছাত্র হিসেবে মনে মনে প্রণাম জানালাম এই বলে, 'আজ আমাকে যা' শেখালেন, সেই সঙ্গে আরো গভীরে ডুবে উন্নত মানের কাজ করবার জন্যে যে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করলেন, আসলে সেটাই আমার ভবিষ্যতের স্ক্রিপ্ট - কলম থাকুক আপনারই হাতে'।
অন্য ঘটনা পরের পর্বে ...........
এলবামটির লিংক নিচে দেওয়া হলো।
https://open.spotify.com/album/73naOyZU3iEITaoDM2heXj
© tapanbasu. all rights reserved.
photo courtesy : amazon / angel / ragranjani
Comments
Post a Comment