মনে পড়ে-৫ | সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় | Mone Pore Ep#5

মনে পড়ে-৫
কিংবদন্তী অভিনেতা-নাট্যপরিচালক-কবি ও আবৃত্তিকার শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।।


কত কিছু যে মনে পড়ে, আবার অনেক কিছুই মনে পড়ে না। ঘটে যাওয়া ঘটনারা সাদা-কালো পুরোনো ছায়াছবির মতো পর্দায় আসে, দেওয়ালে সেঁটে থাকা ক্যালেন্ডারের পাতা হয়ে পড়ে থাকে স্মৃতির অন্ধকারে, তারিখ সেখানে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায় না। 

সালটা ১৯৯৫, সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ। সেদিন কলকাতার কলামন্দির মঞ্চে এক অন্য-ভাবনার গানের অনুষ্ঠান। শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত-জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে, তাঁর দীর্ঘদিনের ছাত্র হিসেবে আমার একান্ত অবরুদ্ধ এক ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম একটি অভিনব সঙ্গীতানুষ্ঠানের, যেখানে দ্বিজেনদাকে কেন্দ্র করে মুম্বাই, শান্তিনিকেতন ও কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী ও গুনীজনেরা এক-মঞ্চে একই চালচিত্রে উপস্থিত থাকবেন। দ্বিজেনদা নিজেও অত্যন্ত উৎসাহিত ছিলেন আমার অনুষ্ঠান-পরিকল্পনার বিষয়বস্তুতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি নিজেও বেশ টেনশনে - আমার উত্তেজনার পারদ উর্ধমুখী হয়ে খেই হারিয়েছে। এমন অবস্থায় মহা-গোল - সম্পূর্ণ অদেখা-অকল্পনীয় মর্মস্পর্শী রাত-ভোরে পাওয়া এক দুঃসংবাদে। সঙ্গীতের রাজসভায় ইন্দ্রপতন - সলিল চৌধুরী আর নেই আমাদের মধ্যে। এ যে অপূরণীয় ক্ষতি ! রবিঠাকুরের এই উত্তরসূরী যে আমাদের মশাল-হাতে 'স্ট্যাচু অফ লিবার্টি'। বাংলা গানের অন্যতম প্রধান পথদ্রষ্টা। আমার দু'চোখে দু'টি আলাদা অন্ধকার - নিকষ অথচ গভীর কালো। মন বলল, আজকের সান্ধ্য অনুষ্ঠান আয়োজিত হবার কোন আশাই নেই। যাই, বাড়ি যাই - সকলকে তো ফোন করে জানাতে হবে যে অনুষ্ঠান হচ্ছে না। কে নেই সেই আসরে ? মান্না দে, শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত থেকে শুরু করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এঁদের নাম উচ্চারণের আগে ঠিক কোন বিশেষণ প্রয়োগ করলে যোগ্য সম্মান জানানো যায়, সে বিচারের ধৃষ্টতা আমার নেই। এঁরা আজ আসবেন ও গান গাইবেন। ঐ অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বিস্তারিত গল্প পরে কখনো বলব। বিমর্ষ আমি যখন দাদাকে বলে বাড়ি চলে যাব ভাবছি, তখন ওই অনুষ্ঠানের মূল সঞ্চালক আবৃত্তিকার ও বাচিকশিল্পী পার্থ ঘোষ ডাকলেন আমাকে, সলিলদাকে ঠিক যে ঘরে এনে রাখা হয়েছে, তার পাশে একটা কোণার দিকে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, 'আজ অনুষ্ঠান ক্যানসেল হলে তোর ঠিক কতটা ক্ষতি হবে' ? উত্তর করলাম, 'কোন পার্সেন্টেজ রেসিও নেই, সবটাই। এ যে আমার একলার উদ্যোগ, দাদার তৈরী সংস্থা 'উত্তরায়ণী'র নামে'। পার্থদা বললেন, 'দাঁড়া, এ অনুষ্ঠান ক্যানসেল করা যাবে না, আমি দেখছি'। পার্থদা দ্বিজেনদাকে গিয়ে বললেন, 'দ্বিজেনদা, সলিলদার চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি নিজেও যে কখনও কোন বিরূপ পরিস্থিতিতে তাঁর কমিটমেন্ট থেকে সরে যাননি। তেমনি, আজকেও আমরা কোন আপোষ করব না। প্রায় সব শিল্পীরাই এখন এখানে রয়েছেন, তাদের তুমি বলে দাও যে প্রোগ্রাম হবে। সবাইকে  যেমনটি তপন বলে রেখেছে, সেই অনুযায়ী তাঁরা যেন কলামন্দিরে পৌঁছে যান। আর তাছাড়া আজকের অনুষ্ঠান না করা গেলে, এই তপনের এতদিনকার পরিশ্রম, আপনাকে নিয়ে এই গুরুতর্পণ - সবই তো মাঠে মারা যাবে'।

দাদা'র অবভাবিক স্নেহ-প্রশ্রয় ছিল আমার প্রতি। অনেক সময়েই তা ছিল অপ্রকাশিত, কিন্তু আমি বুঝতাম। দাদা সম্মতি দিলেন। বাড়ি এলাম আর সৌমিত্রদা'র টেলিফোন। 'আজ কি অনুষ্ঠান হবে ? কারণ আমার শুটিং আজ স্থগিত হয়ে গেছে। তাহলে তুমি তোমার গাড়িটা ষ্টুডিওতে না পাঠিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিও'। এই ঘটনাটির পিছনে একজন অন্য সৌমিত্র চ্যাটার্জী রয়েছেন। দ্বিজেনদা সৌমিত্রদাকে খুব স্বাভাবিক কারণেই অতি পছন্দ করতেন, এঁরা দুজন এক মঞ্চে থাকলে এঁদের দুজনেরই শিল্পকলার বহিঃপ্রকাশ ঘটত অন্যমাত্রায়, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের শিখরে পৌঁছত এঁদের নিবেদন - যা শ্রোতারা চাক্ষুষ করতেন, মোহিত হতেন। কিন্তু বাস্তবের ঘটনা হলো যে, ঐ কলামন্দিরের অনুষ্ঠানে ঠিক কোন কোন শিল্পী কোন ভূমিকায় উপস্থিত থাকবেন, তার পুরোটাই দ্বিজেনদার কাছে আমার তরফ থেকে surprise ছিল। সৌমিত্রদার উপস্থিত থাকবার খবরও আমি প্রথমে জানাইনি দাদাকে। এঁদের আলোকময় উপস্থিতিতে দাদা কি পরিমাণ বিস্মিত হতে পারেন আর তাঁর চোখে-মুখে কি ধরণের আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে পারে, তা দেখতে চেয়েছিল আমার মন। তাই গানের অনুষ্ঠানের বাইরেও এই আয়োজনের পিছনে আমার নিজের কাছে এক মহার্ঘ মানসিক পরীক্ষা ছিল, যে পরীক্ষার মঞ্চ আমি নিজেই সাজিয়েছিলাম আমারই কাছে। যেদিন আমি সৌমিত্রদার বাড়িতে গিয়ে ৫ই সেপ্টেম্বরের আমন্ত্রণ জানালাম, উনি এক কথায় রাজি হলেন। এবার আমি আরেক প্রাসঙ্গিক প্রফেশনাল প্রশ্ন উত্থাপন করলাম তাঁর কাছে, একটু সঙ্কোচের সঙ্গে। উনি দ্বিধাহীন উত্তর করলেন, 'তপন, এই অনুষ্ঠানে যেতে পারাটাই আমার পুরস্কার। আর সেই অনুষ্ঠান যদি কোন ছাত্র তাঁর গুরুকে সম্মান জানাতে আয়োজন করে, তার মর্মই আলাদা। আমার জন্যে শুধু একটা গাড়ি পাঠিও'। গান শিখেছি সামনে বসে অনেক গুরুর কাছে, কিন্তু আজও প্রতিনিয়ত শিখে চলেছি সেই সমস্ত গুণী ব্যক্তিদের সান্নিধ্য পাবার সুবাদে নানা মুহূর্ত-ঘটনার সৌজন্যে, যাঁদের কাছে অন্যের আদর্শ হবার ও অপরকে প্রভাবিত করবার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। ঐদিন সৌমিত্রদার বাড়িতে তাঁকে গুরুসম্মানে প্রণাম জানিয়েছিলাম। উন্মনা মন বিবশ হয়েছিল উচ্চমার্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতির এমন দৃষ্টান্তমূলক মেলবন্ধনের উদাহরণে।

আজ সেই দিনগুলো চোখের সামনে যখন ভেসে ওঠে, আবার ঝাপসা দেখি। তাই আজ আর নয়, আবার সামনের পর্বে আরো কয়েকটি মুহূর্তকথা, 'আমার পথের পাঁচালি' বাংলার অবিসংবাদী নায়ককে নিয়ে।

©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy >asianet / bollywood  hungama  

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু