মনে পড়ে-৪ | সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় | Mone Pore Ep#4

মনে পড়ে-৪
কিংবদন্তী অভিনেতা-নাট্যপরিচালক-কবি ও আবৃত্তিকার শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।।

সৌভাগ্যের সেই মুহূর্ত । সৌমিত্রদা'র সঙ্গে কাজের ফাঁকে আলাপচারিতার সোনালি দিন 

সেদিন দুপুরে হঠাৎ দাদা'র টেলিফোন। দাদা অর্থে আমার অন্যতম সংগীতগুরু শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। সেটা ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের যুগ। বললেন, 'কাল বিকেলে তৈরি থেকো, আমি তোমাকে বাড়ি থেকে বিকেল ৫টা নাগাদ তুলে নেব। গ্রান্ড হোটেলে একটা অনুষ্ঠান আছে'। এমনিতেই এই সুযোগ আমার কাছে আশীর্বাদ-স্বরূপ। আর তাছাড়া দাদার আবদার মানে ওটাই আদেশ এবং কোন মানসিক টালবাহানা ছাড়াই সে আদেশ শিরোধার্য। পরদিন বিকেলে চাপা আনন্দ-উত্তেজনার মিশেলে তৈরী হলাম, দাদার সাথে পৌঁছলাম গ্রান্ড হোটেলে। হোটেলের Banquet-এ অনুষ্ঠান, হৃদয়ের ডাক্তারদের আয়োজনে সে এক এলাহী ব্যবস্থা। পৌঁছে দেখি, সেখানে উপস্থিত রয়েছেন সৌমিত্রদা, সে সময়েই তারা হয়ে ওঠা সেই কিংবদন্তি অভিনেতা শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই কিশোর তাঁর মুখোমুখি হবার প্রথম দিন, যে দিনটি থেকেই ওই এক-কুড়ি বয়সের কিশোরের তাঁকে নিয়ে মোহ ও সম্মোহনের শুরু। লাল রঙের হাতা-গোটানো ফুল শার্ট, বিস্কুট রঙের ট্রাউজার। দাদাকে ঢুকতে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দুই কিংবদন্তী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন - আয়োজক ডাক্তারদের নিশ্চুপ শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টি - ঘড়ির কাঁটার হঠাৎ থমকে যাওয়া। আমার মনের মনিকোঠায় ঐ থেমে যাওয়া মূহুর্তের ছবি আজও সযত্নে লালিত। 

অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করলেন তিনি - ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাঙালি-অবাঙালি Heart Specialist-দের সভায় তাঁর রবীন্দ্রকবিতা থেকে জীবনানন্দ হয়ে শক্তি-সুনীলের সৃষ্টিকল্পে সঁপে দেওয়া মোহিনী কণ্ঠ ভেঙে দিল ভাষা-দ্বন্দ্বের আবরণ। ঐ আমার প্রথম দর্শণে ভাল লেগে যাওয়া ও তাঁর দর্শনে অনুপ্রাণিত হওয়া ........ এক আলোকবর্তিকার পিছু পিছু - তাঁর আলোর আকর্ষণে - তাঁর আলোয় পথ চিনে। আসলে তিনি যে নিজেই নিজগুণে আলোর রোশনাই নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন। দৃষ্টান্তের বহু নমুনা পরীক্ষিত - তবু সে সন্ধ্যাতেও তাঁর আচরণ তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধার ভিত মজবুত করেছিল উপস্থিত সভ্যদের। নিজের অনুষ্ঠান শেষ করেই কিন্তু সৌমিত্রদা সেদিন বেরিয়ে গেলেন না। দর্শকাসনে প্রথম সারিতে বসে তিনি দ্বিজেনদার গান শুনলেন অনেকক্ষণ। তারপর প্রকাশ্যে দাদার অনুমতি নিয়ে গ্রান্ড হোটেল ছাড়লেন। ছোট্ট দেখা, কিন্তু অনেক কিছু দেখবার রাস্তা খুলে দেওয়া এক সন্ধে। 

এরপর সালটা বোধ হয় ২০০২ কি ২০০৪। আমি কলকাতার এক নামি বেসরকারি চ্যানেলের জন্যে তাদের হয়ে ইংরেজি নববর্ষের অনুষ্ঠান পরিচালনা করছি, শুটিং চলছে ডায়মন্ড হারবারে জোকা'র কাছে Merline Ibiza নামক এক রিসোর্ট-এ। হঠাৎ জেনারেটার গেল খারাপ হয়ে। সন্ধে নেমেছে - এক আলো আঁধারি পরিবেশ। আমার ওই অনুষ্ঠানে সৌমিত্রদা'র শুটিং সবে শুরু হয়েছে। বিষয় ছিল, চারুলতা ছায়াছবিতে 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে' গানটি Relive করা। সেদিন মাধবী মুখার্জীও রয়েছেন। তো হঠাৎ এমন অন্ধকারে সৌমিত্রদাকে এক অদ্ভুত গল্পের মুড পেয়ে বসলো। আমিও সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম ফেলুদা ও গুপী-বাঘা চরিত্রের casting নির্বাচন নিয়ে। সৌমিত্রদা এক কাপ কফি নিয়ে বেশ গুরুতর মুখ করে বললেন 'হলো না' । "অনেক তদ্বির করেও আমি ওই গুপী'র রোলে সুযোগ পেলাম না। তখন এক অন্ধ ভক্তের মানিকদা মানে সত্যজিৎ রায়ের অফিস-এ বা শুটিং ফ্লোর-এ সুযোগ পেলেই চলে যাওয়া। (সৌমিত্রদা গড়গড়িয়ে বলে চলেছেন, তাঁর ওই কথা বলা অভিব্যক্তিপূর্ণ চোখ পুরনো রাস্তায় ইতিহাসের পাতায় স্মৃতি হাতড়াচ্ছে)।

"শুনলাম গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর জন্যে তিনি কাস্ট খুঁজছেন। বাঘা'র চরিত্রে রবি ঘোষের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু গুপির চরিত্রে কাউকে পছন্দ হচ্ছে না। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে গুপী'র চরিত্রে আমার চেয়ে এই মুহূর্তে ভাল কাস্ট আপনি পাবেন না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় অনড়। শেষে সরাসরি ওনাকে নিজের ইচ্ছের কথা বেশ জোরাল ভাষায় জানালাম। তার ঠিক পরের দিন, ওই জলদগম্ভীর কণ্ঠের ওজন আরো তিনগুণ বাড়িয়ে উনি বললেন, 'আমি গুপী পেয়ে গেছি'। ভয় ও উৎসাহ নিয়ে মন বলল, নিশ্চই তিনি এবার মনস্থির করে ফেলেছেন - আমিই হবো ওনার গুপী। আসলে ওই চরিত্রটা আমাকে খুব নাড়া দিত। খুব কঠিন ভার্সাটাইল একটা রোল। মানিক মামা (আমার যতদূর মনে পড়ছে সৌমিত্রদা মানিক মামা বলেই সম্বোধন করেছিলেন সেদিন, তবু ভুল হতে পারে) বললেন, 'জানো, তপেন চট্টোপাধ্যায় নামে একজনের অভিনয় দেখলাম এক গ্রূপ থিয়েটারে। ঠিক যেন আমার গুপী'র চরিত্র। 

খুব আশাহত হয়েছিলাম সেদিন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এ রোল আমি পেলে একেবারে মন খুলে অভিনয় করতাম। কিন্তু যেদিন প্রথম শো দেখতে গেলাম, আমি একেবারে তাজ্জব। এমন natural acting কি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো ? পরে আলোচনা প্রসঙ্গে একদিন সত্যজিৎ রায় আমাকে বলেছিলেন, তোমার কথাও আমার মনে ছিল, কিন্তু গুপী'র চরিত্রে আমার এমন এক মুখের প্রয়োজন ছিল, যেখানে দর্শক রূপের গুণে, স্মার্টনেসের কারণে গুপীকে দেখবে না, দেখবে রূপকথার দেশে অসম্ভব সব কার্যকলাপ ঘটানো একটি অত্যন্ত সাদামাটা ছেলেকে। যার বোকামির অভিনয় থাকবে বিশ্বস্ত"।

জেনারেটার ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিস্ময় ছিল আমাদের দুই'পক্ষে - সৌমিত্রদা'র বিপক্ষে আমরা সেদিনের কুশীলবরা ....... শ্রোতা হয়ে।

সত্যি এ এক অপার ভালোলাগার জগত - অবাক করা এমন অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায় তাঁর বিয়োগান্তক দৃশ্যে। ভয় হয়, এমন অনুভব নিয়ে কাজ করবার মানুষগুলোকে আবার খুঁজে পাব তো ? ধৈর্য আর সময় - যুগের হাওয়ার কাছে এ দু'য়েরই যে বড় অভাব। বাংলার সেলুলয়েড-এ শরীর ও মস্তিস্ক -সমব্যবহারে তা শিল্পীর অভিনয়কে শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করবে - এমন আপোষহীন নিশ্চয়তা কি আজ আছে ? আমরা যে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছি দিনে দিনে ! কোথাও বড় একা হয়ে যাচ্ছি না তো ?

©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy > author 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু