মনে পড়ে-২ সুনন্দা পট্টনায়েক | Mone Pore-2 Sunanda Patnaik
মনে পড়ে-২
সঙ্গীতজ্ঞা বিদূষী শ্রীমতি সুনন্দা পট্টনায়েক
বহু বছর তাঁর কোন গান রেকর্ড হয় নি - এও তাঁর কাছে এক বড় আক্ষেপ। একজন শিল্পীর প্রবীণ বয়সে যে ভাবনা-চিন্তা তাঁকে কোন বেদনায় গ্রাস করতে পারে, তা আগাম ভেবে আমি কেমন যেন এক বিষণ্ণতায় চুপসে যাই মাঝে-মধ্যেই। বলেই ফেললাম, 'দিদি, আমি যদি আপনার কণ্ঠ রেকর্ড করতে চাই, আপনি অনুমতি দেবেন' ? সুনন্দাদি যেন স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। ছেলেমানুষের মত বলে উঠলেন, 'শোন্ তপন, একটা ভজন গাইব, বুঝলি ? তারপর কোন রাগটা করি বলতো'? ষ্টুডিওতে যেদিন গান রেকর্ড হবার কথা, তার আগে যখন তখন দিদির ফোন আসত। আজ একবার আসতে পারবি? কখন যে সম্বোধনে 'তুই' চলে এসেছে নজর করিনি। ছুটতাম দিদির কাছে। কি অসীম আগ্রহ ! গানকে এই বয়সেও শ্রেষ্ঠতম করে উপস্থাপন করবার। আমি আশ্চর্য হই আর আমার প্রতি ঈশ্বরের অকৃপণ করুণার কথা স্মরণ করি। এমন সাধিকার সান্নিধ্যে আসতে পারা কম সৌভাগ্যের কথা তো নয় ! দিদি বলতেন, 'আমার কিছু চাই না তপন। তোর কাছে আমি কোন টাকা চাইনে, আমার রেকর্ডটা তুই কত আগ্রহ নিয়ে করছিস। আমি যেন ভাল গাইতে পারি। টাকা কি হবে রে ? যতদিন আমার গলায় সুর আছে, আমার কাছে সব আছে'।
সঙ্গীতজ্ঞা বিদূষী শ্রীমতি সুনন্দা পট্টনায়েক
সেদিন অফিস থেকে বেরোতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। সল্ট লেক থেকে গাড়িটা নিয়ে সবে লেক টাউন ফ্লাইওভার ধরব, ফোনটা এল। তপনদা, আমায় তুমি মনে করতে পারবে কিনা জানি না। আমি অরিন্দম, আমরা গুরুভাই - একসঙ্গে কিছুদিন গান শিখেছিলাম। আমার গান শেখা মানে তো প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে, যে কোন রসদ থেকে। এর শুরু সেই প্রথম দিন, যেদিন মা'র গলায় গান শুনতে শুনতে গানকে ভালবেসেছিলাম। তবু গুরুভাই বলতেই তাঁদের কথাই প্রথমে মাথায় এলো, যাঁদের কাছে আমি বহুদিন গান শিখতে পেরেছি ও গানসংক্রান্ত জ্ঞান আহরণের সুযোগ পেয়েছি। অরিন্দম বলল, 'আমি রবীন্দ্রসংগীত কিছুদিন শিখেছিলাম দ্বিজেনদার কাছে'। বয়সের ফারাক বিচার না করেই পিতৃ বা মাতৃসম গুরু কত সহজে আমাদের দাদা, কাকু, জেঠু হয়ে ওঠেন এবং সেটা সম্ভব হয় তাঁদেরই আপন করে ছাত্র-ছাত্রীকে কাছে টেনে নেওয়ার প্রবৃত্তিতে। গভীর প্রাপ্তির অন্দরমহলে যেই দ্বিজেনদার ছবি ও তাঁর কাছে থাকার মুহূর্তগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, অরিন্দম বললে, 'আমি এখন খেয়াল শিখি সুনন্দাদির কাছে'।
আমি তো লাফিয়ে উঠলাম। কতদিন ভাবছি, আমার ভাগ্যে-সৌভাগ্যে কত মহা-মনীষী গুণী মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি, কিন্তু আজ অবধি সুনন্দাদির কাছে পৌঁছনোর সুযোগ ঘটে নি। অরিন্দম বলল, 'একবার দিদির কাছে যাবে তপনদা ? দিদি তোমাকে কিছু বলতে চান। আমি তোমার কথা দিদিকে বলেছি, তুমি কি ভাবে বাংলা গান ও মার্গ সংগীত নিয়ে কাজ করবার চেষ্টা করো, সেটাও দিদি শুনেছেন'।
মনকে বোঝাই, আমি তেমন কিছুই আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারি নি, যা এঁদের মত ব্যক্তিত্বের কাছে পেশ করা যেতে পারে। তবু, ভারী আশান্বিত হলাম, সুনন্দাদির কাছে একবার গিয়ে পরীক্ষা তো দেওয়া যেতেই পারে। যদি তাঁর মনের কথা শুনতে পাই ? যদি তাঁর কণ্ঠ আমার রেকর্ড কম্পানিতে ধরে রাখতে পারি ? সংগ্রাহক ও সংরক্ষকদের দু'রকম মনের ক্ষুধা থাকে। বিশেষ কিছু খুঁজে বার করে নিজের কাছে রাখা, যা চট করে খোলা বাজারে পাওয়া যাবে না। আর ভবিষ্যতে তা সমাজের কাজে লাগবে, সংরক্ষণ এক ঐতিহাসিক মূল্যায়নের পটভূমি রচনা করবে। আমার সে ধরণের কাজ যে বড়ই প্রিয়। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সেই সন্ধেতেই আর বাড়ি না গিয়ে গাড়ি ঘোরালাম সল্ট লেক পূর্বাচলের ঠিকানায়, যেখানে সুনন্দাদি থাকেন। বুঝলাম, আমার বন্ধু দিদির বাড়ি থেকেই ফোন করেছিল।
২০১৬ সালের গল্প বলছি, দিদির তখন প্রায় ৮২ বছর বয়স। শক্ত-সমর্থ ও মনের জোরে যে কোন যুবা বয়েসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা-সম্পন্ন সাদা চুল ও সাদা থান পরা সুনন্দাদির চোখে মুখে এক একনিষ্ঠ সাধিকার ঔজ্জ্বল্য। একতলায় বসবার ঘরে আড়ম্বরহীন আসবাব। অত্যন্ত সাধারণ একটি ডিভান মত যেখানে খোলা হারমোনিয়ামটুকুই শোভা পাচ্ছে। একটি মাত্র সোফা ও ঘরের ডানদিকে দেওয়ালে লাগলো কাঠের তাকে ৪টি ক্যাসেট, দিদির ছবি দেওয়া। কত সামান্য প্রয়োজনের পরিকাঠামোয় নিজেরই গড়ে তোলা রুদ্ধদ্বার সীমাবদ্ধতায় একক কণ্ঠশিল্পীর সাধনার সংকল্পে অসামান্য হয়ে ওঠা।
পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে দিদি বড় আপন। আমাকে ও ঘর থেকে নিজে হাতে কেক এনে খাওয়ালেন। বললেন, 'আমার ঘরে চা-এর পাট নেই, করবার লোকও নেই। একাই থাকি। সেই কোন কালে বাংলাকে ভালোবেসে দেশ ছেড়েছিলাম, এই বাড়ি কেনবার টাকাও ছিল না। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গৃহযোজনার বিজ্ঞাপনে এই বাড়ি আমি কেনবার আগ্রহ প্রকাশ করি, পরে তাঁরা আমাকে এইটুকু দাক্ষিণ্য করেন যে আমাকে ইনস্টলমেন্টে টাকা ফেরত দেবার সুযোগ করে দেন। নাহলে এই বাড়ি কেনবার টাকা আমার ছিল না। বুঝলে তো তপন ? সেভাবে টাকা পয়সা নিয়ে তবে গান করব এমন তো বাসনা নিয়ে গান করতে বাংলায় আসিনি। একদিন এক ক্লাসিকাল কনফারেন্সেই এক শ্রোতা আমার গান শুনে বললেন, 'দিদি, তারানাটি আরেকবার শুনতে পারি ? আমরা আজ বাড়ি ফিরতে চাইনা, সারারাত আপনার খেয়াল ও তারানা শুনতে চাই। আমি ভাবলাম, সারা দেশে এমন শ্রোতা কই ? যাঁরা এভাবে গান-পাগল হতে পারেন ? ব্যাস, সেই যে বাংলাকে ভালবাসলাম, আর তাকে ছেড়ে যাই নি। এই অরিন্দমের মত ছাত্ররা আছে, আর আমার কি চাই। একাই তো কাটিয়ে দিলাম ...... আর তো ক'টা দিন ! আজ কানে বাজছে তাঁর ওই কথাগুলি আর সুনন্দাদির ভজন গান "জগন্নাথ স্বামী"। একবার রবীন্দ্রসদনে তাঁর 'জয়জয়ন্তী' শুনে পাগল হয়ে গেছিলাম। তাঁর কণ্ঠের বিশেষত্ব এই যে, তিন সপ্তকেই তার অত্যন্ত শ্রুতিমধুর বিচরণ এবং তার-সপ্তকে অনেকক্ষণ সুরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক অপূর্ব রাস্তায় দ্রুত মধ্য-সপ্তকে ফিরে আসা। তারপর তো তারানার কোন কথাই নেই।

অবশেষে সেই গান রেকর্ড হল। কি অনন্ত আগ্রহে সুনন্দাদি গান রেকর্ড করলেন। এই বয়েসে যা তিনি করলেন তা হয়তো তাঁর মত শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। খুব কষ্টও হল দু'দিন এভাবে টানা বসে গান রেকর্ড করতে। পরে রেকর্ডিস্ট-এর সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝলাম, সেই রেকর্ডিংয়ে আরো অনেক পরিমার্জন প্রয়োজন - যার জন্যে আরো বেশ কয়েকবার দিদিকে ষ্টুডিওতে এসে একই রাগ দুই বা তিনবার গাইতে হবে। কারণ এটা শাস্ত্রীয় সংগীত, এখানে কোন নির্দিষ্ট টাইমলাইন বা মিউজিক ট্র্যাক নেই যে একাধিক জায়গা থেকে কোন কোন অংশ কেটে বসিয়ে দেওয়া যাবে। আমার সেই মুহূর্তে মনে হল, ওই গান যদি রেকর্ড-আকারে প্রকাশ পায় কোন পরিমার্জন ছাড়াই, তাহলে ভারী অবিচার হবে দিদির মত এমন এক প্রতিভাময়ী সংগীতশিল্পীর ক্ষেত্রে। অথচ খুব ইচ্ছে করছে এমন একটা রেকর্ড আমার কোম্পানির রেকর্ড লেবেল থেকে প্রকাশিত হোক, আমার নিজস্ব লাইব্রেরিতে শোভা পাক - আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকেও অন্তত অপার শান্তি পাব মনে মনে - যে ভাললাগাটা আমার একার, অন্যের কাছে তুলে ধরবার কোন অভিপ্রায় থাকবে না।
কিন্তু না, পারলাম না সে রেকর্ড আজও প্রকাশ করতে। বন্ধু অরিন্দম পুরোটাই ষ্টুডিওতে ছিল, কাজেই তার মনেও একই অনুভূতি জেগেছিল। সেও বুঝেছিল আমার মনের কথা। তবু বলেছিলাম, দিদিকে বোলো গান ভারী সুন্দর হয়েছে, একটু এডিটিং প্রয়োজন। সেটা ষ্টুডিওতে হয়ে গেলেই আমরা রেকর্ড প্রকাশ করতে পারব। মন বলছে, এই অবস্থায় যদি গান প্রকাশ করি, তাহলে সুনন্দাদির যে গান শ্রোতার কানে আজও বাজে, তা থেকে হয়তো বিচ্যুত হতে পারে। খুব স্বাভাবিক কারণেই এই বয়সে আর যাই হোক, নবীনের উচ্ছ্বাস বা সুর লাগানোর মুন্সিয়ানা অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়ে, কিন্তু তার আবেগ হয়তো সম্পূর্ণভাবে অন্তর্হিত হয়ে যায় না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিল্পীর চোখ আকুল প্রতীক্ষায় থাকে প্রবীণ বয়সের অনুভবের মাত্রা যাচাই করবার বাসনায়। এদিকে আমি কোন দোটানায় পড়লাম ! কি করি সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারলাম না। রেকর্ডটি অপ্রকাশিতই রইল। ভেবেছিলাম, আরো কিছুদিন পরে দিদিকে বাড়িতে গিয়ে শোনাব গানগুলি - তারপর সম্ভব হলে আরো একবার ষ্টুডিও রেকর্ডিং-এর চেষ্টা করব।
সে কাজ আর করে উঠতে পারলাম না। সত্যকে গোপনীয়তার আশ্রয় থেকে উদ্ধার করে সুনন্দাদির এতো আগ্রহের সেই কাজ দিদির কাছে পৌঁছে দিতে পারলাম না। আমাদের ছেড়ে তিনি এ বছর জানুয়ারী মাসে চলে গেলেন তাঁর সাধনার আশ্রমে। এক তীব্র অপরাধবোধে ২০১৯-এ আর তাঁর বাড়ি যেতে পারিনি। যদি তিনি জিজ্ঞেস করেন, 'হ্যাঁ রে, আমি কি গাইতে পারিনি ? তুই রেকর্ডটা বের করলি না কেন রে' ? - এর আমি কি উত্তর দেব ?
তিনি আর কোন উত্তরের প্রতীক্ষা না করে হয়ত এক না-বলা কষ্ট নিয়েই ঈশ্বরলোকে পাড়ি দিলেন। তাঁর কণ্ঠ রেখে গেলেন, সম্ভবত সেটাই তাঁর সর্বশেষ ষ্টুডিও রেকর্ডিং, তাঁর অসীম সাধনার ধন, আমার কাছে গচ্ছিত রেখে। ...... আমায় ভালবেসে চিরঋণী করে। ......
আজ যদি সে রেকর্ড সংগীতের স্বার্থে প্রকাশও করি - পারব কি সুনন্দাদিকে একবার শোনাতে ?
দিদি, আমাকে ক্ষমা কোরো।
©tapan basu. all rights reserved.
Picture Courtesy > self archive - photo>Soumya Sarkar
Comments
Post a Comment