সেদিন চৈত্রমাস । কবিতা || Sedin ChoitraMas (Poetry)


সেদিন চৈত্রমাসকবিতা

তখন আমি চব্বিশ কি পঁচিশ -
ডাক পড়ল প্রবাসে,
সুদূর আমেরিকায়।

বাঙালিরা আমার গান শুনতে চায়
আমার গান মানে রবিঠাকুর,
আর তার পরবর্তী সময়ের গান -
সবটাই অন্যের থেকে ধার নেওয়া।

তবু, আমার সেই গানেই 'তুমি' মন্ত্রমুগ্ধ !
তুমি থাকতে আমাদের ঠিক পাশের পাড়ায় -
আমার বাড়ির সামনে দিয়েই 
তোমার স্কুলের রাস্তা।

বন্ধু ছিলাম আমরা 
মিলেছিলাম আপন হতেই,
খেলার ছলে, গানের টানে।


প্রতিদিন সকালে স্কুলের পথে 
আমাদের দোতলার বারান্দার দিকে -
তোমার চোখ পড়ত ;
একদিন আমার চোখে পড়ে গেল। 

তৈরী হল নতুন অভ্যেস -
সকাল ছ'টায় চোখ মেলে জেগে ওঠা,
চোখে চোখ রাখব বলে। 

তারপর চলতো টানা রেওয়াজ -
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে 
খেলার মাঠে ;
তুমিও আসতে -
তোমার বান্ধবীদের সাথে নিয়ে।


দুটি পরিবারই জানত 
আমরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু,
সুখ-দুঃখের সমব্যাথী ;
কোন আড়াল ছিল না
একে অপরের কাছে -
আত্মপ্রকাশে।
বুঝতাম, বন্ধুত্বের বাইরেও 
আমার গান তোমায় টানে।

সেই গান নিয়ে আজ আমি প্রবাসের পথে;
আমার এমন সৌভাগ্যে 
তোমার আকুলতা -
আমায় সারা আকাশপথ মেঘলা রেখেছে।

হোটেলে পৌঁছেই একটা 'কলিং কার্ড' কিনে 
তোমায় ফোন করতেই 
সে কি তোমার উত্তেজনা !
আমার চেয়েও তোমার কলকল অনর্গল প্রশ্নবাণ -
খুশির উৎসাহের সেই অনুরণন 
আজও আমার মনের ক্যানভাসে 'মোনালিসা'। 

আমরা বেড়ে উঠতে লাগলাম -
বাড়তে থাকল আমাদের পরিচিতি।
প্রতিবেশী দুই পাড়াতেই 
আমরা তখন আলোচনার বিষয়।

আমাদের ওই বন্ধুত্ব 
শুধু দুজন মানুষের ছিল না,
ছিল অভিন্নহৃদয় দুটি মনের।
যে ঠিকানায় অনেক কাহিনী 
সঞ্চিত হতো নির্ভরতায়,
গোপনীয়তার প্রবেশ ছিল না। 

হঠাৎ একদিন তুমি উজাড় করলে 
সাম্প্রতিক এক অনুভবের কথা -
একটি হাতে লেখা চিঠি 
দেখালে আমায়।

ঝরঝরে সুন্দর হস্তাক্ষরে,
একটি নতুন নামে 
তোমায় ওই নবীন সম্বোধন করেছেন -
স্নেহের 'মিতা' বলে। 

তুমি বললে -
'ভারী চমৎকার কবিতাও লেখে, জানো ?
এবার শারদীয় পুজোসংখ্যায় 
গল্পও ছাপা হবে'।
কি অপূর্ব আবেগে অকপটে জানালে,
"পূর্ণেন্দু তোমায় ভালবাসে"।
এই প্রথম জানলাম -
লজ্জার রং  গোলাপী হয়। 

হঠাৎ করে 'ভালবাসা'র 
এক অন্য মানে আবিষ্কার করলাম সেদিন ;
আমি লেখালেখি পারি না,
অন্যের গান কণ্ঠে নিয়ে 
শ্রোতাদের কাছে ছুটে বেড়াই। 

গানের প্রতি নিজের অস্বাভাবিক ভালবাসার বাইরেও 
আমার গান-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে 
তোমার গভীর অনুসন্ধান 
আমাকে অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল -
সন্দেহ নেই। 

তোমার নতুন পরিবার, সারাদিনের পার্বণী -
যাবতীয় উপাখ্যান জানাতে পরেও তুমি কুন্ঠা করো নি। 
তবে সকালে রেডিওতে 
তোমার কান পেতে বসে থাকা,
আর বিকেলের খেলার মাঠের 
সবুজের রং, ফিকে হয়ে এসেছিল -
সময়ের সাথে সাথে। 

এখন আমি প্রবাসেই থাকি - 
নামী কলেজে অধ্যাপনা করি -
সাহিত্য বিষয়ে। 
আমার লেখালেখি শুরু হয়েছিল 
অনেক পরে -
সেই কলমের জোরেই 
পেলাম এই চাকরির ডাক। 

বিদেশের মাটিতে পা রেখেই 
একটা 'কলিং কার্ড' কিনেছিলাম -
ফোনের নম্বরটা বদলে গেছে জানতাম -
তবু -
ডায়ালে হাত রাখলাম -
কোন 'রিংটোন' নেই -
ফোনটা 'ডেড'। 

পুনশ্চ : আজ বসন্তের শেষ সন্ধ্যা। পশ্চিমি দেশে সূর্যাস্ত হয়েছে অনেক পরে। 
আমার জীবনের বেলা বেড়েছে, যৌবনের সূর্য অস্তাচলে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। 
লেখালেখি শুরু করার দিনটাও বেশ পুরোনো হল - 
কিন্তু কাউকে আর 'মিতা' বলে ডাকা হয়ে ওঠে নি। 
একাই থাকি -
ঝরাপাতাদের সাথে কথা বলি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে -
চোখে পড়ে 'আলোর রাজা'র অস্তাচলের পথে বিলিয়ে দেওয়া গোধূলির বর্ণচ্ছটা -
আমার উত্তরীয়কে আগুন রঙে রাঙিয়ে দিতে -
'সে অপেক্ষায় রয়েছে' ।।



তপন বসু/৭ এপ্রিল ২০২০/কলকাতা 
©tapan basu. all rights reserved.

Comments

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু