শ্রীচরণেষু মা | Shreecharanesu Maa

শ্রীচরণেষু মা,

আজ ১০ই মে, তোমাকে এই চিঠি লিখছি জাপান থেকে। আজ তো "Mother's Day" মা - আমার প্রণাম নিও।

তোমার ওপর আমার একগুচ্ছ অভিমান জমা হয়ে আছে মা !
এতগুলো মাস কি'করে একটাও কথা না বলে থাকলে তুমি !
অথচ বাবাকে বলতে, 'খোকা কেমন পা ছোঁড়ে আজকাল, জান তো ?
তুমি কিন্তু এক মুহূর্তও আমাকে ছাড় নি।
আজকেও তো তাই মা !
অন্ধকার থেকে এই প্রথম আলোয় এলাম -
দেখলাম, তুমি আমায় চেপে ধরেছ, তোমার চোখে জল -
কেন, তা বোঝবার মাথাই তো তৈরী হয় নি।
ডাক্তারজেঠু বললেন, 'এই যে ম্যাডাম, আপনার থেকে খোকার নাড়িটা আলাদা করে দিলাম।
সুতোটুকু শুধু , নাড়ির টান'টা নয়।
সেদিনও কিছু বুঝিনি।

মনে আছে, যেদিন প্রথম কথা বলতে শিখেছিলাম,
আমি তোমায় ডেকেছিলাম।
তুমি একছুট্টে এসে আমায় বুকে তুলে নিয়েছিলে -
সেই আমার প্রথম কাকলি।
তোমার চোখে সেদিনও জল ছিল, কেন বুঝিনি !
তোমার হাত ধরে 'অ আ ক খ' আর 'চার-এর নামতা' পর্যন্ত শিখেছিলাম।
ভাল স্কুলে যেদিন ভর্তি হই,
শুনে ফেলেছিলাম বাবার কথা, তোমার কানে,
ফিসফিসিয়ে !
'এত নামি স্কুলে আমাদের পরিবারে এই প্রথম কেউ ভর্তি হলো -
কি বিশাল বিল্ডিং, জানো ?
আশেপাশে কত বড় বড় গাছ, সবুজ গালচের মত খেলার মাঠ -
অনেক টাকা মাইনে তো হবেই বলো?
সংসার চালাতে পারবে তো' ?
তুমি বললে, 'শোন না, আজ থেকে আমি আর মাছ-মাংস খাব না, আর তুমি ?
সিগারেটটা ছেড়ে দিও, কেমন '?
চোখ বড় বড় করে পাশ ফিরে শুয়েছিলাম -
মাছ-মাংস বা সিগারেট ছাড়লে ঠিক কি হয় মা ?
সেদিন বুঝিনি।

ক্লাস টেনে বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হলাম।
তুমি কি কান্নাটাই না কাঁদলে -
আমি আজও বুঝিনা মা তোমার-আমার সব আনন্দের মুহূর্তে কেন তুমি কাঁদো ?
আমার যে বড় কষ্ট হয় !
আমি কি তোমার মনের মত হতে পারিনি ?
হ্যাঁ, মানছি -
একদিন তোমায় জোর করে মাছ খাওয়াতে গেছিলাম -
আমার পাতের বড় পিস্-টার থেকে ভেঙে।
তুমি কিছুতেই মুখে দিলে না।
আমার খুব রাগ হয়েছিল -
অনেক অভিমানে তোমায় কত কটু কথাই না শুনিয়েছিলাম -
তুমি কেঁদেছিলে সেদিনও।
কারণ বুঝিনি, কেন না ছোটবেলার অনেক কথাই হারিয়ে গেছিল
একের পর এক সাফল্যের ভিড়ে।

আমার প্রথম চাকরির প্রথম মাইনে হাতে এল,
পুরো মাইনের টাকাটা হাতে নিয়ে বললাম, 'এই নাও বাবা ! এটা তোমার'।
বাবা শুধু মাথায় হাত রেখে বললে,
'তোর মা'কে এবারের জন্মদিনে একটা লাল তাঁতের শাড়ি কিনে দিস তো খোকা -
ওটা অনেক দিন হয়ে গেল রে, due আছে, তুই আর আমি কি আলাদা ?.........
বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে তুমি সেদিনও ভিজেছিলে, নীরবে -
আমার চোখের আড়ালে।
আমায় বললে, 'বাবাকে এক প্যাকেট চারমিনার এনে দিবি খোকা ?
ছেলেবেলায় নাকি তোর বাবা ওই সিগারেটটা খেতে খুব ভালবাসত।
কিন্তু এক প্যাকেট মাত্র, বাবা সিগারেট অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছে'।

সেদিন আমি প্লেনে চড়ব - প্রথমবার। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি আমায় জাপান নিয়ে চলেছে।
মা, তুমি আমায় ছেড়ে কি করে থাকবে গো ?
তোমার যে শুধু খোকা, আর খোকা।
তোমায় রোজ ফোন করব মা, কেমন ?
আমার কথার চিৎকার হারিয়ে গেল এয়ারপোর্টের পেটের ভেতর।
কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখলাম, তোমার দু'হাত কপাল ছুঁয়েছে -
বাবার অপলক তাকিয়ে থাকা আমার ভবিষ্যতে।

একবার মনে আছে মা ? বহুদিন পর ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরছি, তবে একা নয়।
ভাবছি,আজ মা'কে Surprise দেব।
মা, কই তুমি ? তোমার খোকা কাকে নিয়ে এসেছে দেখো ?
তুমি এক লহমায় সব বুঝে গেলে।
কই, আমি তো এতদিনেও তোমার চোখের জলের মানে বুঝতে পারি নি !
তুমি আমাদের নিয়ে গেলে তোমার শোবার ঘরে।
মাথার কাছে বাবার ছবিটা দেখিয়ে বললে,
'চলে যাবার আগে তোকে কতবার যে দেখতে চেয়েছিল !
দেখ তো খোকা ? ওই ড্রয়ারটা ?
ওখানে তোর প্রথম মাইনের সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে দিয়েছিল -
কেবলই ওটা নিয়ে কি যেন লিখত !
আমায় দেখাত না,
বলতো - 'খোকা এলে দেখিও'।

দেখলাম, বাবা পুরো সিগারেটের প্যাকেটে শুধু এটুকুই বারবার লিখে গেছে,
'খোকা, তোর মা তার সব ভালোলাগার ইচ্ছেগুলো ছেড়েছে -
নিজেকে নিজের কাছ থেকেই সরিয়ে নিয়েছে -
সেদিন থেকেই -
যেদিন প্রথম তোকে নিয়ে এ বাড়িতে এলাম।
তোর সঙ্গে আমার আর বোধ হয় দেখা হল না -
খুব বড় হয়ে গেছিস, না রে ?
যাই হোক, যেদিনকেই আসবি, মা'কে সঙ্গে নিয়ে যাবি, সে যেখানেই হোক।
আমার সাথে তার যখন দেখা হবে, সে যেন বলতে পারে -
খোকাই তো আমায় এতদিন আসতে দেয়নি,
তাই দেরি হল।
সে কটা দিন আমি না হয় তোর মা'কে ছেড়ে কাটিয়ে দেব।

তুমি ডাকলে আমায়,
'এবারে ক'দিনের ছুটি পেলি রে ? চার বছর হল তুই চাকরি পেলি !
তোর পাঠানো টাকাগুলো দিয়ে খুব চেষ্টা করেছিলাম বাবাকে সারিয়ে তুলতে।
তুই ছুটি পেলি না।
তুই থাকলে হয়তো তোর বাবা আর ক'টা দিন বাড়তি থাকতো !
তবে শেষের দিনগুলোয় বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল রে !
তোকে আর জানাই নি। খালি খোকা আর খোকা -
ঠাকুরকে ডেকেছিলাম,'এই দু'ই কষ্ট থেকে যাতে সে মুক্তি পায়'।

আমি তোমায় বলতে পারি নি মা - মাত্র ১০ দিনের ছুটিতে সেবারে গিয়েছিলাম।
অফিস থেকে জরুরি ডাক এসেছে বলে প্রায় পালিয়ে এসেছিলাম -
সেদিন কিন্তু আমাদের দুজনের চোখেই জল ছিল।
একটু হয়তো বুঝেছিলাম, কেন জল আসে চোখে !

অহনা'কে বিয়েটা জাপানেই সারতে হল - কিছু বন্ধু-বান্ধবদের উপস্থিতিতে।
তোমায় জানাই নি -
দূরে থেকে তোমার চোখের জল দেখতে চাইনি বলে।
সেও প্রায় এক বছর হয়ে গেল।
ভেবেছিলাম, এবার দেশে ফিরে তোমায় নিয়ে একটা পার্টি দেব।
সেদিন তোমার পছন্দমত সক্কলে উপস্থিত থাকবে,
আর তারপর আমরা তিনজনে মিলে এদেশে চলে আসব।

তোমায় বলি মা,
এখন এখানে আমরা আর দুজন নেই -
প্রথম বিবাহবার্ষিকীর ঠিক আগেই অহনা আমাকে জানাল যে মেলামেশার দিনগুলো
আর বিয়ের পরের দিনগুলোতে আমি মানুষটা নাকি একদম আলাদা।
এমন কোমল মনের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় -
কিন্তু জীবনে একসাথে পা ফেলা যায় না, উচ্চাভিলাষীও হওয়া যায় না।
কিন্তু জানো মা ? বিয়ের আগে - তোমার কথা, বাবার সততা আর আদর্শের কথা যখন বলতাম -
অহনা চোখ বড় বড় করে কি মন দিয়ে শুনত !
সময় কি এতটাই ছোট মা ?
যে তাকে আমরা আরেকটু সময় দিতে পারি না !
ভাবতে গেলেই দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসে !

আজ আমার আর কোন উচ্চাভিলাষ নেই মা -
শুধু ভবিষ্যতের ভল্ট সাজাতে কত আর ভাল লাগে বলো ?
বর্তমানটাই যে হারিয়ে ফেলছি আমি !
পিছনের দিনগুলোতেও যে শুধু তোমার আর বাবার সংসারের অলিন্দে কৃচ্ছসাধন -
সেদিকে তাকালেও যে বুকে চাপ অনুভব করি !
আমি কোথায় যাই বলো তো মা ?

আমার পরশু দেশে ফেরার টিকিট এসে গেছে।
আমার এই চিঠি আর তোমার খোকা -
একসাথেই তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছবে।

পরশু মঙ্গলবার -
আমি বাড়ি পৌঁছলে একসাথে তোমার মা'য়ের কাছে পুজো দিতে যাব।
আমার ঠিকানা আর যেন বদল না হয় - এটাই চাইব তোমার সাথে মন্দিরে গিয়ে।

জননী..... জন্মভূমি.... - এর বাইরেও তো একটা পৃথিবী আছে মা ?
সেটাও তো কম সুন্দর নয় ?
তবু মুহূর্তগুলো কেন লম্বায় বাড়ে না বলতে পারো?
ক্ষণস্থায়ী চাকরি, আরো ক্ষণস্থায়ী নতুন গড়ে ওঠা সম্পর্ক -
চাওয়ার সাথে পাওয়ার হিসেবে এতো ফারাক -
স্মৃতি থেকে স্বপ্ন -
বিগত থেকে আগামী -
মেলানো কি যায় না মা ?
শুধুই চোখের জল পড়ে থাকবে ?
ইতিহাস কি মাত্র যুদ্ধজয়ের বর্ণনা শোনাবে ?

আমি আসছি মা -
আর তুমি কাঁদবে না তো ?
"জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী"

ইতি -
তোমার হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া
'খোকা'
রামায়ণে শ্রীভরদ্বাজ শ্রীরামচন্দ্রকে বলেছিলেন,"Friends, riches and grains are highly honoured in this world. (But) mother and motherland are superior even to heaven." ***  
১০ই মে ২০২০ । রবিবার

***এই উক্তির সূত্রে দ্বিমত থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বক্তব্যে কোন দ্বিমত আছে বলে তো আমার মনে হয় না। 

শ্রীচরণেষু মা । (গদ্য-কবিতা) । তপন বসু 
©tapanbasu. all rights reserved.
photo courtesy > (1)pinterest / (2)tes 

Comments

  1. মায়ের লেখা চিঠি পরে অনুভব..

    তোমাকে ছেড়ে আমি পারিনি বেরোতে বিশ্বভ্রমনে
    তুমিই আমার বিশ্ব।
    পৃথিবীর সাথে আত্মীয়তা মুছে
    যখনই হয়েছি নিঃস্ব
    তোমাতে পেয়েছি বাঁচার রসদ্
    তুমিই আমার বিশ্ব।
    তাইতো যখনই হয়েছি নিঃস্ব
    তোমাতে পেয়েছি বাঁচার রসদ
    তুমিই আমার বিশ্ব।।
    চোখে জল এল আর ভাষা নেই।অপূর্ব আত্মনিবেদন লেখাটিতে।

    ReplyDelete
  2. Ki bhalo likhechhen Tapan Da! Mon chhuye galo....chokh bhije galo..

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

তপনের ডায়েরি ৭ / ৩১ আগস্ট ২০২১

তপনের ডায়েরি ৫ / ৫ আগস্ট ২০২১

স্টেরয়েড ছোট গল্প রচনা : তপন বসু